এত দিন রপ্তানি খাতের বিশেষ নৈপুণ্যের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একরকম সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিতে চাপে পড়েছে বাংলাদেশ।
মোহাম্মদ শরীফ সরকারের কারখানা অনেক দিক থেকেই ছিল মডেল। ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় এক ভবনের তিনটি তলাজুড়ে তাঁর এই কারখানা, তলাগুলো বেশ প্রশস্ত। এই কারখানায় হাজারখানেক তরুণ-তরুণী কাজ করেন। বিশ্বের যেকোনো দেশের যেকোনো হালফ্যাশনের চাহিদা পূরণ করতে তাঁরা সদা প্রস্তুত।
ইদানীং এক সমস্যা হয়ে গেছে। সেটা হলো বিদ্যুৎ–ঘাটতি। দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় জুলাই মাস থেকে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রায় সব ধরনের জ্বালানির দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বাস্তবতায় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে শরীফ সরকারের কারখানার কর্মীদের দিনের একটা সময় চুপচাপ বসে থাকতে হয়। বাজারের ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ডিজেল দিয়ে যে কারখানা চালু রাখবেন, সেই সাহসও করে উঠতে পারছেন না শরীফ সরকার।
লন্ডনভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে শরীফ সরকারের এ কারখানার চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে শরীফ সরকার বলেন, ‘বাজারে সবকিছুর দাম এভাবে বাড়তে থাকলে তৈরি পোশাক খাত অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে আর শেষমেশ কর্মীদেরই সেই বোঝা বহন করতে হবে।’
একসময় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য কারখানার হাত ধরে বাংলাদেশে অনেকটাই এগিয়েছে। চীন ও ভিয়েতনামের পর বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এর সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে। শুধু তাই নয়, সামাজিক ও শিক্ষাসূচকেও বাংলাদেশের অনেক তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন রয়েছে।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এ মুহূর্তে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করছে। কোভিড-১৯–এর প্রভাব তো আছেই, সেই সঙ্গে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বিশ্ববাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। এতে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতায় ভাটা পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। শ্রীলঙ্কা আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের অবস্থাও খুব খারাপ। এই দুই দেশ আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য ধরনা দিচ্ছে।
এ বছরের মে মাসে গত দুই দশকের মধ্যে এই প্রথম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ঋণখেলাপি হয়েছে। দেশটিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে জনবিক্ষোভ এমন আকার ধারণ করে যে সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান খানকেও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। তাদের মুদ্রার দরপতন হয়েছে অনেক। তারা আইএমএফ ও অন্যান্য বিপক্ষীয় দাতাদের সঙ্গে ঋণের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে ঋণখেলাপি হতে না হয়। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দুই দেশ নেপাল ও মালদ্বীপ বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট দেশের তুলনায় অনেক ভালো। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস–এর প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম—৩৯ শতাংশ, যদিও সরকারের হিসাবে তা এর চেয়েও কম। এ ছাড়া সম্প্রতি আইএমএফও বলেছে, বাংলাদেশ সংকটজনক পরিস্থিতিতে নেই, তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা আছে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস–এর প্রতিবেদনের মূল সুর হচ্ছে, বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এত দিন ভালো করলেও সম্প্রতি বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে একধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে, যার জন্য বাংলাদেশ সরাসরি দায়ী নয়। বলা হয়েছে, এত দিন রপ্তানি খাতের বিশেষ নৈপুণ্যের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একরকম সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জ্বালানির ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আমদানি নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবে বিপদে পড়েছে। তবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য বিপদগ্রস্ত দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে।
এদিকে বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের ঋণমান প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহিঃস্থ খাতের চাপে থাকলেও আগামী এক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস বাংলাদেশের ঋণমান নির্ণয় করেছে। দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ঋণমান নির্ণয় করা হয়েছে বিবি মাইনাস এবং স্বল্প মেয়াদের জন্য বি। ২০২১ সালেও তারা একই পূর্বাভাস দিয়েছিল।
তারা বলেছে, বহিঃস্থ খাতের চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের চলতি হিসাব ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের নিট বহিঃস্থ ঋণ পরিস্থিতি দুর্বল হয়েছে। আরও দীর্ঘ সময় যদি পণ্যমূল্য বাড়তি থাকে এবং আমদানির চাহিদা বাড়তি থাকে, তাহলে টাকার আরও অবমূল্যায়ন হতে পারে। এতে অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের আরও অবনতি হতে পারে।
এসঅ্যান্ডপি আশা করছে, বাংলাদেশ আগামী ১২ মাসের মধ্যে অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতে চাপ ও চ্যালেঞ্জ সামলে নেবে। তবে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ও আর্থিক খাতের পরিস্থিতির অবনতি হলে এসঅ্যান্ডপি ঋণমান হ্রাস করতে পারে।