চীনা ঋণের বিষয়ে সরকার কিছুটা ‘ধীরে চলো নীতি’ নিয়েছে। এখন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান ও ভারতের সঙ্গে দর–কষাকষি করছে।
চীনা ঋণের প্রতি বাংলাদেশের আগ্রহ কমেছে। সরকার এখন বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ পেতে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ও ভারতের মতো দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দাতাদের সঙ্গে একের পর এক দর-কষাকষি করছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও মাত্র একটি প্রকল্পে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
মূলত চীনের দেওয়া ঋণ পরিশোধের মেয়াদ কম, শর্ত কঠিন। এ ছাড়া চীনের ঋণ নিলে কাজ করার জন্য সেই দেশের ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হয়। কিন্তু ওইসব ঠিকাদারের কাজের মান নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তাই সরকার চীনা ঋণের প্রতি উৎসাহ হারিয়েছে বলে জানা গেছে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণের সম্পর্ক জোরদার হয় আগের দশকে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরকালে বাংলাদেশকে ২৭টি প্রকল্পে ২ হাজার কোটি ডলার সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণসহ যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতের প্রকল্প রয়েছে। ঋণচুক্তি হয়েছে নয়টি প্রকল্পে। গত কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর গড়ে একটি প্রকল্পের অর্থায়নে চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঋণ নিতে হবে। হঠাৎ করে বিশাল ঋণ নিয়ে যেন জালে আটকে না পড়ি। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো অপেক্ষাকৃত কম সুদের ও নমনীয় শর্তের ঋণকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ জন্য সরকার হয়তো চীনের ঋণে ‘ধীরে চলো নীতি’ অবলম্বন করছে। এটা সঠিক নীতি। কারণ, উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া হয় না বলে চীনের মতো দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নিলে উচ্চমূল্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়। আবার কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থাকে।
২০১৯ সালে ১০টি অগ্রাধিকার প্রকল্প চিহ্নিত করে সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। সেই তালিকার মধ্যে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক, ছয়টি পূর্ণাঙ্গ টিভি কেন্দ্র স্থাপন ও বিজেএমসির আওতায় থাকা সরকারি পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন, রাজশাহী ওয়াসার ভূ–উপরিস্থ পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে। এই তালিকা থেকে শুধু ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক প্রকল্পের ঋণচুক্তি হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে রাজশাহী ওয়াসার ভূ–উপরিস্থ পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে ঋণচুক্তি হতে পারে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। এই প্রকল্পে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে চীন ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ইতিমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) চীনের বরাদ্দও রাখা হয়েছে।
চীনের সহায়তায় নেওয়া প্রকল্পের সুদের হার ২ শতাংশের মতো। তবে ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান ঋণ পরিশোধে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় দেয়। চীনের ঋণ দ্রুত পরিশোধ করতে হয়, তাই কিস্তিও বেশি।
২০১২ সালে শাহজালাল সার কারখানা উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে চীনা ঋণের প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়। এরপর ২০১৩ সালে পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প ও জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো নির্মাণে দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়। দুটি প্রকল্পই শেষ হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের বছরে মোট চারটি ঋণচুক্তি হয়। ২০১৭ সালে হয় আরও দুটি। এরপর প্রতিবছর একটি প্রকল্পের ঋণচুক্তির বেশি হয়নি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৫৪ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। গত ১০ বছরে চীনের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। প্রকল্পগুলোর অন্যতম হলো কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ; শাহজালাল সার কারখানা; দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার; ইনফো সরকার-৩; ইত্যাদি। ইতিমধ্যে শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মা পানি শোধনাগার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন—এই তিন প্রকল্পে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ৯০ কোটি ডলারের মতো ঋণ পরিশোধ হয়েছে।