বাংলাদেশের আয় পশ্চিমে, ব্যয় পুবের দেশে

পশ্চিমা বিশ্ব ও এশিয়ার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

বৈশ্বিক জিডিপি তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, গত বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৪৬০ বিলিয়ন বা ৪৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। সম্ভাবনা আছে, আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০তম অর্থনীতির দেশ হবে। বিশ্বের সরবরাহব্যবস্থায় বাংলাদেশ এখন একটি নির্ভরযোগ্য নাম।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের অংশীদার বিশ্ব অর্থনীতির বড় সব দেশ। দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানির বৃহত্তম গন্তব্য। চীন থেকে আসে সবচেয়ে বেশি আমদানি পণ্য। বেসরকারি বিনিয়োগ আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। আসছে উন্নয়ন সহায়তাও। ধীরে ধীরে বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এসব দেশের সঙ্গে।

আমদানি চিত্র

প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের মধ্যে খাদ্যসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য যেমন রয়েছে, তেমনি আছে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল। আমদানি করা হয় মধ্যবর্তী পণ্যও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ছিল ৭ হাজার ৫০৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরে ছিল ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। ডলার–সংকটের মধ্যে আমদানিতে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে আমদানি ব্যয় কমেছে।

রপ্তানি, প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, শিক্ষা—এই সবকিছুর জন্য আমরা পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কিছুর সঙ্গে এর বিনিময় করা যাবে না। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রেখেই আমাদের পূর্ব দিকে তাকাতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস চীন। যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আসে দেশটি থেকে। আমদানির পেছনে বাংলাদেশ প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, তার এক–চতুর্থাংশের বেশি যায় চীনে। গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয় ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানির উৎস হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। গত এক দশকে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি তিন গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১–২২ অর্থবছরে প্রতিবেশী এই দেশ থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছিল ১ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারের পণ্য।

আর্থিক মূল্যে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানির পরিমাণ কম। তবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পণ্য ও সেবা আমদানি হয় ওই সব দেশ থেকে। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তিপণ্য ও প্রযুক্তি।

রপ্তানি পরিস্থিতি

বাংলাদেশের আমদানির বড় উৎস কিন্তু রপ্তানির বড় গন্তব্য নয়। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় এসেছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যদিকে চীন আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস হলেও রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান প্রায় তলানিতে। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হয়, সেখানে বাংলাদেশ চীনে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও ২০২১–২২ অর্থবছরে রপ্তানি করেছে ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য।

ভারতের চিত্রও প্রায় একই রকম। দেশটি থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি হলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় আরও কমে ১৮৬ কোটি ডলারে নেমেছে। ২০২১–২২ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়েছে ৪৮৩ কোটি ডলারের পণ্য। জোট হিসেবে সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যেখানে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় বাংলাদেশের।

পশ্চিমা এসব দেশের ক্ষেত্রে সুবিধা হলো দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে। অর্থাৎ এসব দেশে বাংলাদেশ রপ্তানি বেশি করে, আমদানি করে কম। চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে চিত্রটা উল্টো।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমের কিছু দেশে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। আর এটা ঘটছে এমন সময়ে, যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের গোষ্ঠী এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান অবশ্য মনে করেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব আরও বাড়বে।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘সম্প্রতি শ্রমিক অধিকার–সম্পর্কিত যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে, বাংলাদেশকে সেটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের অনুধাবন করতে হবে, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মার্কিন উদ্বেগের পরপরই শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি এসেছে।’

সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ

সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) দিক থেকে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানের মতো দেশগুলো। চলতি ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের স্থিতি ২ হাজার ২৪ কোটি ডলার। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের—৩৫০ কোটি ডলার। পরের স্থানটি যুক্তরাজ্যের। কিন্তু পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগে বেশ পিছিয়ে—১২৬ কোটি ডলার। তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলা ভারতের বিনিয়োগ আরও কম—মাত্র ৬৯ কোটি ডলার।

প্রকল্প ঋণ

রপ্তানি গন্তব্য ও বেসরকারি বিনিয়োগের উৎস হিসেবে পিছিয়ে থাকলেও চীন, ভারত ও রাশিয়া এগিয়ে আছে দ্বিপক্ষীয় প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউ বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে আসছে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য এসব দেশ অর্থ সাহায্য দিয়েছে।

অবকাঠামো উন্নয়নে বড় অংশীদার এখন চীন। দেশটি চলমান বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে। কিছু ঋণ আবার কঠিন শর্তের। অন্যদিকে বাংলাদেশ এখন ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা দেশ। তিনটি ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ৭৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি আছে বাংলাদেশের।

তবে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ ও সহায়তা দেওয়ার দিক থেকে এগিয়ে আছে জাপান। স্বাধীনতার পর থেকে গত ২০২১–২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে জাপান।

শিক্ষার্থীদের গন্তব্য

অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্যের বাইরে বড় সম্পর্ক রয়েছে শিক্ষার ক্ষেত্রে। প্রায় সব কটি দেশেই প্রতিবছর বড়সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে যান। তাঁদের অনেকেই পশ্চিমা দেশগুলোতে থেকে যান এবং বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে ভূমিকা রাখেন।

প্রবাসী আয়

প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র গত অর্থবছরে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় আসে ৩৫২ কোটি ডলার। চতুর্থ স্থানে থাকা যুক্তরাজ্য থেকে প্রবাসী আয় আসে ২০০ কোটি ডলার। শীর্ষ চারে আরও আছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। প্রবাসী আয় পাঠানোয় শীর্ষ ৩০ উৎসের মধ্যে জাপান থাকলেও চীন বা ভারত নেই।

অর্থনীতিতে অংশীদার

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি বড় হচ্ছে। ফলে তাদের বাণিজ্য আগামী দিনে আরও বাড়বে। তাই এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের সম্ভাবনা অনেক। সুতরাং আমাদেরও পুবের দেশগুলোর দিকে তাকাতে হবে এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে।’

তবে আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, ‘রপ্তানি, প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, শিক্ষা—এই সবকিছুর জন্য আমরা পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কিছুর সঙ্গে এর বিনিময় করা যাবে না। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রেখেই আমাদের পূর্ব দিকে তাকাতে হবে।’