চাকরি মেলায় চাকরি প্রত্যাশীদের ভিড়
চাকরি মেলায় চাকরি প্রত্যাশীদের ভিড়

দেশে বেকারের সংখ্যা কত

দেশে এখন বেকার লোক কত, তা বলতে পারবেন? নিশ্চিত পারবেন না। প্রায় ছয় বছর আগে দেশে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ বেকার ছিলেন। গত ছয় বছরে নতুন করে কত লোক বেকার হলেন কিংবা কত মানুষ চাকরি পেয়ে বেকারত্ব ঘোচালেন, সেই হিসাব কোথাও নেই। অবশ্য করোনার কারণে বহু লোক বেকার হয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতির কারণে চাকরির বাজারও মন্দা। সেই পরিসংখ্যান নেই।

শ্রমশক্তি জরিপের মাধ্যমে আমরা বেকারত্ব, কর্মজীবী মানুষ, শ্রমশক্তির আকার—এসব তথ্য পাই। ছয় বছর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ করেছে। এরপর আর কোনো জরিপ হয়নি। সম্প্রতি বিবিএস পরের শ্রমশক্তি জরিপ করেছে। ওই জরিপের ফলাফল এখনো পাওয়া যায়নি। এমনকি কোভিডের সময় কত লোক বেকার হয়েছিল, এর সরকারি কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

এসব কারণে বেকার মানুষের প্রকৃত হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাঁদের কর্মসংস্থান কতটা হয়েছে, তা জানা যায়নি। আবার সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে অর্থনীতিবিদদের। তাঁদের মতে, সরকার যে হিসাব দেয়, প্রকৃত বেকারের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।

বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ নাকি ১ কোটি

সর্বশেষ ২০১৭-১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি, তাই তাঁদের বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে পুরো সপ্তাহ খাবার, যাতায়াত, থাকাসহ সব খরচ ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই যাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজের সুযোগ পান না সরকারি পরিসংখ্যানে তাঁদের বেকার হিসাবে ধরা হয়।

তবে বিবিএস আরেকটি হিসাব দেয়, সেটি হলো সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টার কম কাজ করেন, কিন্তু সেই কাজ নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। সোজা কথায়, চাকরি বা কাজ খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে জীবনধারণের জন্য টিউশনি, বিক্রয়কর্মী, উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারকর্মীর মতো কাজ করে থাকেন অনেকে। তাঁদের ছদ্মবেকার হিসেবে ধরা হয়। ২০১৬-১৭ সালের হিসাবে এমন বেকারের সংখ্যা প্রায় ৬৬ লাখ। পুরোপুরি বেকারের সঙ্গে ছদ্মবেকার যোগ করলে বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের ধারণা, কোভিডের কারণে ছদ্মবেকারের সংখ্যা আরও বেড়েছে। তাঁদের একটি বড় অংশ উবার-পাঠাও চালান। আবার অনেকে বিক্রয়কর্মীর কাজে জড়িত।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে বেকার লোকের সংখ্যা কত, তা জানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে যে সংখ্যা দেখানো হয়, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কেউ জীবন ধারণ করতে পারবে না। বেকারত্ব কম করে দেখানোর জন্য ২৭ লাখ বেকার দেখায় বিবিএস। এটা বাস্তবসম্মত নয়। তিনি আরও বলেন, এখন বেকারত্বের যে হিসাব দেওয়া হবে, তাতে কোভিডের সময়ে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়েছিল, তার চিত্র পাওয়া যাবে না। এত বড় ঘটনা পরিসংখ্যানে থাকবে না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২–এর প্রাথমিক হিসাবে, বেকারের সংখ্যা আরও কমেছে। নতুন জরিপে তা ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেছে বলে একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। আগামীকাল বুধবার নতুন শ্রমশক্তি জরিপের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশের কথা রয়েছে বিবিএসের।

সংজ্ঞার মারপ্যাঁচে প্রকৃত চিত্র আসে না আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পেলে তাঁকে বেকার হিসেবে ধরা হবে না। কাজপ্রত্যাশী কেউ যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পান, তাঁদের বেকার হিসেবে গণ্য করা হবে। এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সংজ্ঞা। তবে সব দেশের প্রেক্ষাপট এক রকম নয়। বাংলাদেশে একজন মানুষ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে যে মজুরি পাবেন, তা দিয়ে সারা সপ্তাহ চলতে পারবে না। আবার উন্নত দেশের মানুষ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলে তার জন্য মজুরি পান। পাশাপাশি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও তাঁদের বেকার ভাতা দেওয়া হয়। ফলে জীবনধারণের খরচ জোগাতে তাঁদের খুব বেশি সমস্যা হয় না।

সপ্তাহে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যানে বেকার লোকের সংখ্যা কম। কিন্তু ছদ্মবেকার অনেক বেশি। কাজপ্রত্যাশী হয়েও যাঁরা কাজ পাচ্ছেন না, তাঁরা বাধ্য হয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন। তাঁদের বাধ্যতামূলক বেকারত্ব বলা হয়। এ ধরনের বেকারত্ব তিন ধরনের। যেমন সামঞ্জস্যহীনতাজনিত বেকারত্ব, বাণিজ্য চক্রজনিত ও কাঠামোগত বেকারত্ব।
শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি থাকলে সেটিকে সামঞ্জস্যহীন বেকারত্ব বলে। উত্তরবঙ্গ ও হাওর অঞ্চলে এমন বেকারত্ব দেখা যায়। এ ছাড়া অর্থনীতিতে চাঙাভাব কিংবা মন্দাভাবের কারণেও অনেক সময় বেকারত্ব বাড়ে-কমে। যেমন কোভিডের কারণে বেকারের সংখ্যা বেড়েছিল। আবার প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণেও বেকারত্ব বাড়ে। এ ধরনের বেকারত্বকে কাঠামোগত বেকারত্ব বলে।