পেনশন
পেনশন

রাষ্ট্রায়ত্ত–স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা আর সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আসছে দুটি পেনশন কর্মসূচি

প্রত্যয় চালু হবে আগামী ১ জুলাই; আর সেবক চালু হবে ২০২৫ সালের ১ জুলাই। ১০ মাসে চার পেনশন কর্মসূচির গ্রাহক তিন লাখ ছাড়িয়েছে।

আসছে আরও দুটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা কর্মসূচি। একটি সরকারি কর্মচারীদের জন্য, আপাতত যেটির নাম রাখা হয়েছে ‘সেবক’। আরেকটি কর্মসূচি রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা সমজাতীয় সংস্থাগুলোর জন্য। এর নাম ‘প্রত্যয়’। প্রত্যয় চালু করার যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ। আর সেবক চালুর কাজ শুরু হয়নি এখনো। এটি চালু হবে ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে।

আগামী ১ জুলাই থেকে চালু হতে যাওয়া ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত হবেন রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সব কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারী প্রত্যয়ের আওতাভুক্ত হবেন।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৬ জুন বাজেট বক্তব্যে সরকারি চাকরিতে নতুন নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতাভুক্ত করার ঘোষণা দেন। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পেনশন সুবিধা পান এমন সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের আমরা সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসব। স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ইতিমধ্যে এ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। শিগগির অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্যও আমরা এ ব্যবস্থা ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে চালু করব।’

প্রগতি, সমতা, প্রবাস ও সুরক্ষা—এই চার কর্মসূচি নিয়ে সর্বজনীন পেনশন চালু হয় গত বছরের ১৭ আগস্ট। ১৩ জুন পর্যন্ত এসব কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে।

পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাংশের শিক্ষকেরা বৈষম্যের কথা বলে প্রত্যয় কর্মসূচি চালুর বিরোধিতা করে আসছিলেন। এখন মনে হয়, সেই বিরোধিতা আর করবেন না তাঁরা। কারণ, ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্যও সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বাধ্যতামূলক হচ্ছে।’

তবে প্রত্যয় বাধ্যতামূলক করার জন্য স্বশাসিত বা সমজাতীয় সংস্থার বর্তমান কর্মীরা যে প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল (সিপিএফ) সুবিধা পাচ্ছেন, আইন সংশোধন করে তা বাতিল করতে হবে। সে কাজে হাত দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।

পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুব কমসংখ্যক স্বশাসিত বা সমজাতীয় সংস্থায় পেনশন কর্মসূচি চালু আছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই সিপিএফ ব্যবস্থা প্রযোজ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সংস্থার ব্যতিক্রম উদাহরণ ছাড়া এ ব্যবস্থায় চাকরি শেষে পেনশন পান না কেউ, পান এককালীন আনুতোষিক।

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে তুলনা করতে আমরা যাচ্ছি না। আমরা সুবিধাই পাই সামান্য, তা–ও আবার কর্তন করা হচ্ছে। আমরা অবসরে যাই ৬৫ বছর বয়সে, আর সরকারি কর্মচারীরা যান ৫৯-৬০ বছর বয়সে। আমাদের জন্য প্রত্যয় বাধ্যতামূলক করা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী। এ ব্যবস্থা চালু করা হলে আমাদের সর্বাত্মক আন্দোলনে যেতেই হবে।’

প্রত্যয় যাঁদের জন্য প্রযোজ্য

অর্থ বিভাগের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান অর্থ—৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত কোনো ব্যবসায় উদ্যোগ, কোম্পানি, ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান অথবা শিল্প-বাণিজ্য–সম্পর্কিত বা অনুরূপ কোনো প্রতিষ্ঠান। আর স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হচ্ছে আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, কমিশন, সংস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি।

প্রত্যয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কর্মচারীদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা—এই দুইয়ের মধ্যে যেটা কম, তা তাঁদের বেতন থেকে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এরপর উভয় অর্থ জমা হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে। যাঁদের ন্যূনতম ১০ বছর চাকরি আছে, তাঁরা আগ্রহী হলে প্রত্যয় কর্মসূচির আওতায় আসতে পারবেন। আবার ১০ বছর চাকরি থাকা বিদ্যমান চাকরিজীবীরা বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও থেকে যেতে পারবেন।

প্রত্যয় চালু হলেও বিদ্যমান কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে না। বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দেয়। প্রত্যয় কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠান দেবে মূল বেতনের সমান অর্থাৎ ১০ শতাংশ। যদি কোনো কর্মচারী ৩০ বছর চাঁদা দেন, তাহলে অবসরের পর অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে ওই কর্মচারী মাসে ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা করে পেনশন পাবেন।

যেসব সুবিধার কথা বলা হচ্ছে

পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, ৩০ বছর ধরে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে চাঁদা জমা হবে ৯ লাখ টাকা; আর সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা। ওই কর্মচারী যদি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ। পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে বলে এ অঙ্ক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সর্বজনীন পেনশন যদি সর্বজনীন হয়, তাহলে কোনো কথা নেই; কিন্তু দেখতে হবে যে সত্যিই তা সর্বজনীন হচ্ছে কি না। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কিন্তু বলছেন তাঁদের বিদ্যমান সুবিধা কর্তন করা হচ্ছে। এটা উচিত নয়।