মূল্যস্ফীতির চাপ

খরচ সামলাতে সঞ্চয় ভাঙছেন মানুষ

নতুন করে সঞ্চয়পত্র যে পরিমাণ কেনা হচ্ছে, নগদায়ন হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এতে দিনে দিনে এসব বিনিয়োগ পণ্যে মানুষের জমানো টাকা কমে যাচ্ছে।

করোনার কারণে নতুন কর্মসংস্থানের গতি কমেছে। চাকরিও হারিয়েছেন অনেকে। আবার ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। মানুষের আয় না বাড়লেও জীবনযাত্রার ব্যয় ঠিকই বেড়ে গেছে। ফলে সংসার চালাতে অনেকে হাত দিচ্ছেন জমানো টাকায়। নতুন সঞ্চয়ও কমিয়ে ফেলেছেন।

মানুষ প্রথমত টাকা জমা রাখেন ব্যাংকে। এরপর বেশি নিরাপত্তা ও বেশি সুদের আশায় অনেকে টাকা সঞ্চয়পত্রেও বিনিয়োগ করেন। আবার ডাক বিভাগের সঞ্চয় ব্যাংকেও অনেকে টাকা জমা রাখেন। প্রবাসীরা বিদেশ থেকেও তিন ধরনের বন্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন। এসব বিনিয়োগে ব্যাংকের সঞ্চয় থেকে বেশি সুদ পাওয়া যায়। আবার রয়েছে কর ছাড়সহ নানা সুবিধাও।

সুদ বেশি হলেও ব্যাংকের বাইরে সরকারি বিভিন্ন বিনিয়োগ পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। ফলে নতুন করে সঞ্চয়পত্র যে পরিমাণ কেনা হচ্ছে, নগদায়ন হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এতে দিনে দিনে এসব বিনিয়োগ পণ্যে মানুষের জমানো টাকা কমে যাচ্ছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর—এই তিন মাসে সঞ্চয়পত্র, ডাক বিভাগের সঞ্চয় ও বিভিন্ন বন্ডে জমানো অর্থ কমে গেছে ২ হাজার ১১ কোটি টাকা। সঞ্চয় অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে ব্যাংকের আমানতও গত নভেম্বরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। অবশ্য নভেম্বরে ব্যাংক আমানত কমার অন্যতম কারণ ছিল ইসলামী ব্যাংকের অনিয়মের ঘটনা। এ কারণে অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেন।

ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উচ্চ সুদের পরও মানুষ এখন সঞ্চয়পত্র কিনছেন কম; বরং নগদায়ন তথা ভাঙিয়ে ফেলছেন বেশি।

ব্যাংকের বাইরে জমা কমল

গত নভেম্বর শেষে সঞ্চয়পত্র, ডাক বিভাগের সঞ্চয়, এনআরবি বন্ড, প্রাইজবন্ড, পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বিনিয়োগ কমে হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। অক্টোবরে যা ছিল ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে এসব খাতে মানুষের জমানো টাকা ছিল ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। আর আগস্টে ছিল ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এর আগে কোনো মাসে এসব সরকারি বিনিয়োগ পণ্যে বিনিয়োগ এতটা কমেনি।

এসব বিনিয়োগ পণ্যে যে টাকা জমা হয়, তা অবশ্য দিন শেষে ব্যাংকে সরকারি হিসাবে জমা হয়। কারণ, এসব বিনিয়োগ পণ্য মূলত সরকারের ঋণ গ্রহণের অন্যতম মাধ্যম।

সঞ্চয় বেশি কমেছে সঞ্চয়পত্রে

সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ ৯৮৩ কোটি টাকা কমে গেছে। কারণ, এই মাসে মানুষ সঞ্চয়পত্রে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, তার চেয়ে বেশি নগদায়ন বা ভেঙে ফেলেছে। শুধু নভেম্বর নয়, অক্টোবরেও সঞ্চয়পত্রে ৯৬৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল। এর আগে সেপ্টেম্বরে কমেছিল ৭০ কোটি টাকা। তবে জুলাই ও আগস্ট মাসে সঞ্চয়পত্রে যথাক্রমে ৩৯৩ কোটি টাকা ও ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ বেড়েছিল। এর আগের মাসগুলোর চিত্রও ছিল একই রকম।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে. মুজেরি বলেন, ‘অর্থনীতির অবস্থা ও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্তরা বাধ্য হয়ে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। রমজান মাসের আগে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। এখন সরকার এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যত দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নেবে, ততই সংকট কমবে।’

মুস্তফা কে. মুজেরি আরও বলেন, সরকারের নীতিগুলো হতে হবে সাধারণ মানুষবান্ধব। যাতে মানুষ ভালো থাকেন। নির্দিষ্ট কোনো শিল্পগোষ্ঠী বা কোনো খাতকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নীতি গ্রহণ করা হলে তা সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসবে না।

ব্যাংকের আমানতও কমেছে

মানুষ প্রথমে সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখেন। তবে এখন অনেকে খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন সঞ্চয়ও কমে গেছে। আতঙ্কে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে রাখছেন। এর ফলে গত ডিসেম্বরে শুধু একটি ইসলামি ব্যাংকেরই আমানত কমেছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে সার্বিকভাবে আমানত কমেছে। গত অক্টোবরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। তা নভেম্বরে ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা কমে হয় ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।

অবশ্য আমানত কমার বড় কারণ, ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনার জন্য এক লাখ কোটি টাকার বেশি চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। এতেও অর্থসংকট বেড়েছে। অনিয়ম ও সাম্প্রতিক সংকটের কারণে কিছু ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না কিছু ব্যাংক। ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের পাশাপাশি গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক চাহিদামতো সিআরআর রাখতে পারেনি।

কমছে জাতীয় সঞ্চয়ও

দেশের মানুষের সঞ্চয় কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনেও এই তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে মোট জাতীয় সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ; আগের অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয় কমেছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

একই সময়ে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ও কমেছে। সেই অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, আগের অর্থবছরে যা ছিল ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক অর্থবছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে সঞ্চয় কমেছে।