অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা 

সুশাসনে পিছিয়ে বিসিক, আর্থিক সূচকে পিডিবি 

রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত ১০ সংস্থার ওপর প্রথমবারের মতো এ পর্যালোচনা করেছে অর্থ বিভাগ। চারটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যালোচনা করা হয়।

ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত ১০ সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। আর বিভিন্ন আর্থিক সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এ ছাড়া পরিচালন দক্ষতার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তদারকি সেলের এক স্বাধীন পর্যালোচনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন চিত্রই উঠে এসেছে। অর্থ বিভাগ প্রথমবারের মতো সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়ে এ পর্যালোচনা করেছে। পর্যালোচনা করা হয় ১০টি সংস্থার ওপর। যেসব সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়, সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল), বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি), বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি)। 

প্রতিবেদনটির বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তাই এটির বিস্তারিত আমি কিছু জানি না। আমি মনে করি, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমানেই বিসিকের গভর্ন্যান্স সবচেয়ে উন্নত। তবে দক্ষতার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। অর্থাভাবে বিসিক তার প্রকল্পগুলোতে অনেক কিছুই করতে পারে না।
মুহ. মাহবুবর রহমান, চেয়ারম্যান, বিসিক

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চারটি প্রধান সূচকের ওপর ভিত্তি করে সংস্থাগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়। সূচক চারটি হলো  সংস্থাগুলোর ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, পরিচালন দক্ষতা, আর্থিক অবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন। এই চার সূচকের মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপসূচকে আবার আলাদা আলাদা মানদণ্ড ছিল। এসবের ভিত্তিতে সংস্থাগুলোর ২০২১–২২ অর্থবছরের পারফরম্যান্স বা কার্যক্রম মূল্যায়ন করে অর্থ বিভাগ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চার সূচকে স্কোর বা মানের দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বিএফআইডিসি। আর চার সূচকের মানের ভিত্তিতে সংস্থাগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বোয়েসেল। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আলাদা আলাদা মানদণ্ডের ভিত্তিতে চার সূচকের জন্য সর্বোচ্চ মান নির্ধারণ করা হয় ৪। এর মধ্যে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও পরিচালন দক্ষতা সূচকে ছিল সর্বোচ্চ মান, ১ দশমিক ২০ করে। আর আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন এ দুটি সূচকের মান ছিল দশমিক ৮০ করে। সর্বমোট ৪ স্কোরের (নম্বর) মধ্যে বোয়েসেল ৩ দশমিক ৬৩ নম্বর পেয়ে পারফরম্যান্সে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পারফরম্যান্সে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বিএসসি, সংস্থাটির স্কোর ৪–এর মধ্যে ৩ দশমিক ৫৪। তৃতীয় স্থান পাওয়া বিবিএ ৩ দশমিক ৪৪ নম্বর পেয়েছে। চতুর্থ অবস্থানে থাকা সিপিএর স্কোর বা অর্জিত নম্বর ৩ দশমিক ২০। এই চার সংস্থা ছাড়া বাকি ছয়টির কোনোটিই ৩–এর বেশি নম্বর পায়নি।

আমরা সম্প্রতি প্রতিবেদনটি হাতে পেয়েছি এবং আমাদের ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। অন্যান্য সংস্থার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও বনশিল্প করপোরেশন লাভজনক সংস্থা। তারপরও যেসব সূচকে আমরা পিছিয়ে আছি, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে সেগুলোতে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নাসির উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারম্যান, বিএফআইডিসি

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীন পর্যালোচনা নীতিমালার আওতায় এ পর্যালোচনা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, কারিগরিভাবে দক্ষ ব্যক্তি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত টিম এই স্বাধীন পর্যালোচনা করে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সংস্থাগুলোকে আরও বেশি কার্যকর করতে পর্যালোচনাটি করা হয়েছে। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সূচকে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে বিসিক। বিসিকের পরে রয়েছে যথাক্রমে পিডিবি ও বিএফআইডিসি। এ সূচকে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে শীর্ষে রয়েছে বোয়েসেল। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বিএসসি ও সিপিএ।

জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান বলেন, ‘প্রতিবেদনটির বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তাই এটির বিস্তারিত আমি কিছু জানি না। আমি মনে করি, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমানেই বিসিকের গভর্ন্যান্স সবচেয়ে উন্নত। তবে দক্ষতার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। অর্থাভাবে বিসিক তার প্রকল্পগুলোতে অনেক কিছুই করতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘অবসর ভাতাসহ আর্থিক সুবিধা কম থাকায় সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একধরনের হতাশা কাজ করে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে বিসিক শিল্পনগরগুলোর সেবার মানও বাড়ানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া আরও কিছু সমস্যা রয়েছে আমাদের। তাই পরিকল্পনা করলেও সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না।’

পরিচালন দক্ষতা সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে পর্যটন করপোরেশন। পিছিয়ে থাকার দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) ও বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি)। এ সূচকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে বোয়েসেল ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া আর্থিক সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বিপিডিবি। এ সূচকে সবচেয়ে ভালো অবস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি)। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। এ কারণে আর্থিক প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সরকারি অন্যান্য সংস্থার তুলনায় বিএসসি অনেক এগিয়ে ছিল বলে পর্যালোচনা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। করোনাকালে বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহন ও জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি ভালো ব্যবসা করেছে, যার প্রতিফলন এর আর্থিক সূচকে পড়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন। এ সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বিসিক। বিসিকের পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই সূচকে শীর্ষে রয়েছে বিএসসি ও বিপিডিবি। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্বাধীন এ পর্যালোচনায় সার্বিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফআইডিসি) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি যখন তৈরি করা হয়, তখন আমি এ সংস্থায় ছিলাম না। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি আমরা হাতে পেয়েছি এবং আমরা আমাদের ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। অন্যান্য সংস্থার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও বনশিল্প করপোরেশন লাভজনক সংস্থা। তারপরও যেসব সূচকে আমরা পিছিয়ে আছি, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে সেগুলোতে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

নাসির উদ্দিন আহমেদ আরও জানান, এরই মধ্যে বিএফআইডিসির কার্যক্রম ও ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফার্নিচার তৈরির দেশীয় শীর্ষ ব্র্যান্ড হাতিল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রবার খাতের উন্নয়নেও একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।