দুই দেশের মধ্যকার আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১০০ কোটি ডলারের বেশি ঘাটতি রয়েছে। তবে বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাধীনতার পর থেকে গত ২০২১–২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলার অর্থসহায়তা দিয়েছে জাপান। এককভাবে বাংলাদেশকে অর্থসহায়তাকারী শীর্ষ দেশ জাপান।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এগিয়ে জাপান। উন্নত অনেক দেশে বাংলাদেশ রপ্তানি বড় পরিমাণে বাড়াতে পারলেও জাপানের ক্ষেত্রে তা হয়নি। রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আসছে পোশাক খাত থেকে। গত ২০২১–২২ অর্থবছরে জাপানে ১৩৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এ রপ্তানির বিপরীতে গত অর্থবছরে জাপান থেকে আমদানি হয়েছে ২৭৭ কোটি ডলারের পণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে জাহাজ, বোর্ড, লোহা ও ইস্পাত, গাড়ি, শিল্পের যন্ত্রপাতি, চশমা, ফটোগ্রাফি ও সিনেমাটোগ্রাফির যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী—বিভিন্ন জরিপে এমন তথ্য উঠে এলেও দেশটি থেকে বিনিয়োগ এখনো কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জাপানি বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশে প্রায় ১০৭ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। দেশে কর্মরত জাপানি কোম্পানির সংখ্যা তিন শতাধিক।
জাপানি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এক হাজার একর জমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিশেষ এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হলে জাপান থেকে বড় বিনিয়োগ আসবে, এমন প্রত্যাশা করা হচ্ছে। জাপানের সুমিতমো করপোরেশনের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) যৌথভাবে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, চীনে পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে জাপানের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। জাপানি বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এসব কোম্পানির কারণে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে চীন। জাপান এখন চীন থেকে তাদের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে। জাপানি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে।
বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারি গড়ে তুলতে আগ্রহী জাপান সরকার। সম্প্রতি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপানি সহায়তা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ এ দেশে বাড়লেও দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যঘাটতি কমাতে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। তাই পোশাকের বাইরে জাপানে রপ্তানির সম্ভাবনা আছে, এমন পণ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য খুব বেশি না বাড়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপানে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে তৈরি পোশাক। তবে জাপান মূলত উচ্চ মূল্যের মানসম্মত পোশাক আমদানি করে। এ ছাড়া দেশটির ভোক্তারা এখন কৃত্রিম তন্তুর পোশাক বেশি ব্যবহার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ স্বল্প দামি পোশাকই বেশি রপ্তানি করে থাকে। এ কারণে জাপানের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাপান আমাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু। তা সত্ত্বেও আমরা দেশটিতে রপ্তানিতে ভালো করতে পারছি না, কারণ তারা যে ধরনের পোশাক আমদানি করে, আমাদের দক্ষতা সেখানে কম। পোশাকের বাইরে তেমন কোনো পণ্যও আমরা জাপানে রপ্তানি করি না।’
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগের বড় ধরনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা বিগ–বি–কৌশলের আওতায় দেশটি মাতারবাড়ীতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বিগ–বি সুবিধাকে কাজে লাগাতে পারলে জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে জাপান-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ১৮৭ কোটি ডলারের, আর রপ্তানি ১১৩ কোটি ডলার। করোনাভাইরাস মহামারির পর জাপান থেকে পণ্য আমদানি বেড়ে যায়, তবে সেই গতিতে রপ্তানি বাড়েনি। ফলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি বেড়ে যায় বাংলাদেশের। করোনার পর ২০২০–২১ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৮ কোটি ডলারে। এর মধ্যে আমদানির পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি ডলারের আর রপ্তানি ১১৮ কোটি ডলারের।
জাপান থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আসে পোশাক খাত থেকে। পোশাকের বাইরে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং চামড়াবিহীন জুতা।
তবে গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে জাপানে রপ্তানি বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ বছর ১৯০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে। তার মধ্যে প্রায় ১৬৩ কোটি ডলারই আসে পোশাক ও বস্ত্র খাতের রপ্তানি থেকে। তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাজারে ১০৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে জাপান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে। সেই হিসাবে এই বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি খুবই নগণ্য।
তবে শুধু পোশাকনির্ভরতার মাধ্যমে জাপানে রপ্তানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর ব্যাপারে খুব বেশি সম্ভাবনা দেখছেন না ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা। তাই তাঁরা এ দেশে জাপানের বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, দেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়িয়েই জাপানের বাজারে রপ্তানি বাড়াতে হবে।
গত আগস্টে বাংলাদেশসহ এশিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনাকারী জাপানি কোম্পানিগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিস্থিতিবিষয়ক একটি সমীক্ষা করে জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)। এতে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ২১৪টি জাপানি কোম্পানি অংশ নেয়। সমীক্ষাটির ফলাফল গত আগস্টে প্রকাশ করা হয়।
ওই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৭২ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনার কথা জানায়। ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রধান কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো উল্লেখ করে, এ দেশে ব্যবসার খরচ এখনো কম।
জাপানি কোম্পানিগুলো এ–ও জানিয়েছে, বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচও কম। জাপানে যে পণ্য উৎপাদনে ১০০ ডলার খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে সেই পণ্য উৎপাদনে খরচ ৬০ শতাংশ কম।
তবে জেট্রোর জরিপে অংশ নেওয়া জাপানি কোম্পানিগুলো ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুটি বিষয়ে তাদের অপছন্দের কথা জানিয়েছে। প্রথমটি ব্যবসার অনুমোদন ও সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি, দ্বিতীয়টি করব্যবস্থার অদক্ষতা। প্রায় ৮০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি মনে করে, এ দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আর ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশ জাপানি কোম্পানি মনে করে, করব্যবস্থার অদক্ষতা ব্যবসার ক্ষেত্রে এ দেশে বড় বাধা। এ ছাড়া বিদেশি মূলধনের আইনি কাঠামো বা ভিত্তি তৈরি এবং বিদেশিদের ভিসা ও কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) প্রাপ্তির জটিলতাও বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে জাপানি কোম্পানিগুলো মনে করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় জাপানি বিনিয়োগ এসেছে ২০১৮ সালে। ওই বছর প্রায় ১৪৮ কোটি ডলারে বাংলাদেশি একটি তামাক পণ্যের কোম্পানি কিনে নেয় জাপান টোব্যাকো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৮৩টি। চলতি বছরের জুন শেষে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫০টিতে। বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, প্রায় ২০ কোটি ডলার। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় সাত কোটি ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে নির্মাণ খাতে।
বর্তমানে জাপানের সহায়তায় কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকায় মেট্রোরেলের মতো বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে।
জাপানের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি ও বিনিয়োগ সম্ভাবনায় বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে জাপান–বাংলাদেশ চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় যেভাবে জাপানি বিনিয়োগ বেড়েছে, বাংলাদেশে সেভাবে বাড়েনি। তার বড় কারণ, আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশ কম উন্নত। দেশের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন যতটা হয়েছে, ব্যবসা সহায়ক পরিবেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সেভাবে হয়নি। অনেক দেরিতে হলেও আমরা জাপানের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি। বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হলে এ দেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়বে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেরও উন্নতি হবে।’