দেশে চিকিৎসা বাবদ মানুষের পকেট ব্যয় বাড়ছে। বাস্তবতা হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা বাবদ ব্যক্তিগত ব্যয় বা পকেট খরচ সবচেয়ে বেশি।
অর্থাৎ দেশে চিকিৎসা খাতে সরকারের ব্যয় অনেক কম। এতে অনেক পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে; অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস আয়োজিত এক সেমিনারে এসব তথ্য দেওয়া হয়। সেমিনারটি গতকাল সোমবার বিআইডিএসের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়; পরবর্তীকালে এর ভিডিও রেকর্ড বিআইডিইসের ফেসবুক পেজে দেওয়া হয়।
সেমিনারে বলা হয়, ২০২২ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এই স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। অর্থাৎ তখন দেশে যত দরিদ্র মানুষ ছিলেন, তার মধ্যে ২০ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে এই স্বাস্থ্যগত কারণে।
এর মূল কারণ চিকিৎসা বাবদ মানুষের পকেট ব্যয় বেড়ে যাওয়া। ১৯৯৭ সালে যা ছিল ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২০ সালে ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে তা ৭৩ শতাংশে উঠে যায়।
‘বাংলাদেশে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ের ধাক্কা ও দারিদ্র্য: ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপনা দেন বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো আবদুর রাজ্জাক। প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।
গ্লোবাল হেলথ এক্সপেনডিচার ডেটাবেজ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ব্যক্তি মানুষের চিকিৎসা বাবদ যত ব্যয় হয়, তার ৭৩ শতাংশ ব্যক্তিকে বহন করতে হয় অর্থাৎ সরকার বহন করছে মাত্র ২৭ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে কেবল আফগানিস্তানে এই ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, যেখানে প্রতি ১০০ টাকা স্বাস্থ্য ব্যয়ের মধ্যে ব্যক্তির পকেট ব্যয় ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ।
বিনায়ক সেন উপস্থাপনার ওপর আলোকপাত করেন। বলেন, বড় ধরনের অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে; আবদুর রাজ্জাক এই দুটি বিষয়ের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছেন।
বিষয়টি অর্থনৈতিক সাহিত্যে অনেক দিন ধরেই আলোচিত বিষয়। এ বিষয়ে একটি বই আছে ভারতীয় লেখক অনিরুদ্ধ কৃষ্ণের, যার নাম ‘ওয়ান ইলনেস অ্যাওয়ে’। অর্থাৎ একটি অসুস্থতার কারণে মানুষ ধনী থেকে মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত বা গরিব হয়ে যেতে পারে, বলেন বিনায়ক সেন।
বিআইডিএসের আরেক গবেষণার সূত্রে বিনায়ক সেন বলেন, দেখা গেছে, যাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ অসুখ-বিসুখের কারণে; বাকি ৬৫ শতাংশ হয় অর্থনৈতিক কারণে।
আবদুর রাজ্জাকের কাজের বিশেষত্ব সম্পর্কে বিনায়ক সেন বলেন, তিনি খানা আয়-ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, অসুখ-বিসুখের কারণে কত মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যান।
উপস্থাপনায় আবদুর রাজ্জাক দেখান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে কম মালদ্বীপে—সেখানে এই ব্যয়ের মাত্র ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ ব্যক্তিকে বহন করতে হয়, বাকি অংশ সরকার বহন করে। এরপর ব্যয় সবচেয়ে কম ভুটানে, সেখানে জনপ্রতি ব্যয় হয় ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কায় এই ব্যয় ৪৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, ভারতে ৪৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, নেপালে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ আর পাকিস্তানে ৫৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা না গেলে ঢাকা শহরে বসে বড় বড় কথা বলে লাভ হবে না। গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না।
এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর লক্ষ্য হচ্ছে, গ্রামের চিকিৎসাব্যবস্থা ঠিক করা; এরপর ঢাকা ও বড় শহরের চিকিৎসাব্যবস্থা ঠিক করা।
স্বাস্থ্য খাতের জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দের দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে; স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। অথচ সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিচ্ছে আফগানিস্তান; জিডিপির ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে তারা।
এরপর সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিয়েছে মালদ্বীপ—১০ দশমিক ০৩ শতাংশ। নেপালের বরাদ্দ ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ, ভুটানের ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ভারতের ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ আর শ্রীলঙ্কার ৪ দশমিক ০৭ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে আবদুর রাজ্জাকের পরামর্শ, দেশে বড় পরিসরে স্বাস্থ্যবিমা চালু করা।
অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের গবেষক ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।