বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কারণে অনেক পণ্যই উভয় দেশে উৎপাদিত হয়। কিন্তু এসব পণ্যের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সচেতন নয়। দেখা যাচ্ছে, এমন অনেক পণ্য ভারত নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা বাংলাদেশেও উৎপাদিত হয়। সে কারণে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি থাকা উচিত।
জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আজ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্প্রতি বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার (ডব্লিউআইপিও) এক সম্মেলনে সুন্দরবনের মধুকে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, সুন্দরবনের মধুর বড় অংশই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থিত বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত হয়। এর আগে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়েও এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এ বাস্তবতায় উভয় দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে জিআই বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থাকা উচিত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের আলোচ্যসূচিতে এ বিষয়টি থাকা উচিত ছিল বলে বক্তারা মনে করেন।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক ২০১৭ সালে সুন্দরবনের মধুকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য করার জন্য ঢাকায় আবেদন পাঠান; কিন্তু এই সাত বছরে তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন ভারত তা করে ফেলেছে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির পর এবার সুন্দরবনের মধু ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে এখানেই শেষ নয়, ভবিষ্যতে এমন আরও অনেক পণ্যের জিআই নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিবাদ হবে। এই পরিস্থিতিতে অভিন্ন আইনি কাঠামোতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা পাওয়া যাবে না। যেমন বাসমতি চালের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সবারই বাসমতি চালের জিআই আছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই বাস্তবতায় বাংলাদেশকে পণ্যের পূর্ণাঙ্গ ও পর্যাপ্ত তালিকা তৈরিতে প্রয়োজনে সমীক্ষা করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও এ রকম বিবাদ হচ্ছে। চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়ার মধ্যে একটি অ্যালকোহল পণ্য নিয়ে বিবাদ ছিল। এরপর ইউরোপীয় আইনের অধীনে এর সমাধান হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার জিআই–সংক্রান্ত বিবাদ নিরসনে স্বীকৃত আইনি কাঠামো তৈরির পরামর্শ দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘লিসবন অ্যাগ্রিমেন্টে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে; এই মানদণ্ড বুঝতে হবে। ইউরোপ আমাদের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের বড় বাজার।’ সে জন্য ইউরোপের বাজারে ঢুকতে গেলে এই অ্যাগ্রিমেন্টে অংশ নেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
মেধাস্বত্ব ছাড়া উদ্ভাবন সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে পুঁজি ও শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতেও মেধাস্বত্ব দরকার। এলডিসি উত্তরণের পর এই প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্যও এটি জরুরি। এ ছাড়া ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই লাভ করা নারী শ্রমিক, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য জরুরি বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘জিআই সংরক্ষণে আমরা সচেতন নই। টাঙ্গাইল শাড়ির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০২০ সালে ভারত এর জিআইয়ের আবেদন করে। এরপর ২০২৪ সালে তারা সেই নিবন্ধন পায়। তারা ঘোষণা দেওয়ার পর আমাদের বোধোদয় হয়।’ তিনি আরও বলেন, জিআই সংরক্ষণ জরুরি এ কারণে যে এটি কেবল ঐতিহ্য নয়, এর সঙ্গে মানুষের জীবিকাও জড়িয়ে আছে।
ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ ক্ষেত্রে কেবল আইনি কাঠামোর অধীনে আলোচনা করলে হবে না; পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আলোচনা করতে হবে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সেপা (কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) আলোচনায় মেধাস্বত্বের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার মত দেন।
এই পর্যায়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রশ্ন করেন, সেপা কবে হতে পারে। এর মধ্যে কীভাবে মেধাস্বত্ব নিয়ে আলোচনা হবে? জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আলাদাভাবে চুক্তি হতেই পারে, তবে একটি বড় চুক্তির অধীনেও তা নিয়ে আসা যায়। সেপা নিয়ে আলোচনা শুরুর ইঙ্গিত আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ছাড়া জিআই সনদ লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; এর ফলোআপও থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন মোস্তাফিজুর রহমান। অর্থাৎ সনদ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না, কীভাবে তা থেকে উৎপাদকেরা লাভবান হতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিয়ে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনের পর সরকার নড়েচড়ে বসে বলে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয় একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। সরকারের এই তৎপরতা সন্তোষজনক বলে মত দেন তিনি।
বক্তারা বলেন, অনেক পণ্যের জিআই বাংলাদেশ ও ভারত আলাদা আলাদাভাবে নিয়েছে। এতে সেই পণ্যের রপ্তানিমূল্য কমে যায়, অর্থাৎ এর ফলে উভয় দেশেরই ক্ষতি হয়। সে জন্য অভিন্ন আইনি কাঠামো থাকা দরকার বলে তাঁরা মনে করেন।