বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন (ডান থেকে তৃতীয়)। আজ ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কার্যালয়ে।
বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন (ডান থেকে তৃতীয়)। আজ ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কার্যালয়ে।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে, বড় ভূমিকা মাছের দামের

দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এরপর বেড়েছে মুরগিসহ পোলট্রি পণ্যের দাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা ও  বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) নিজেদের উদ্যোগে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে করা সাম্প্রতিক এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কার্যালয়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। বইটি লিখেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিনায়ক সেন বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে বিআইডিএসের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাতে দেখা গেছে, গরিব মানুষের ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ। বাড়তি এ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছেন। ডিসেম্বরে বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, তাতে সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের কাছাকাছি। এরপর আমরা আমাদের জরিপের তথ্যে পেয়েছি, গরিব মানুষের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা মাছ ও পোলট্রি পণ্যের দামের।’ 

জানা গেছে, বিআইডিএসের জরিপের তথ্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রকাশ করা হয়নি। বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে জানান, জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদনটি আগামী মাসে প্রকাশ করা হবে।

রপ্তানি প্রণোদনা বন্ধের পরামর্শ

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বুধবার বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণের পাশাপাশি ডলারের দাম একলাফে ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করেছে। অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এসব সিদ্ধান্তে মুদ্রাবাজারে চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য তৈরি করবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে।

একই অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকার বলেন, দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া এসব সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এখন রাজস্ব খাতসহ অন্যান্য খাতেও প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।

ডলারের দাম ১১৭ টাকা করার পরে রপ্তানি খাতে আর প্রণোদনা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে অনুষ্ঠানে মত দেন বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, দেশের এই দুর্যোগ মুহূর্তে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো প্রয়োজন। ফলে রপ্তানি প্রণোদনা বন্ধ করা হলে সেই অর্থ সামাজিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন অত্যাবশ্যক খাতে ব্যবহার করা যাবে।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, রপ্তানি প্রণোদনা বন্ধ করা হবে কি না, সেটা সরকার ভেবে দেখতে পারে। সরকার চাইলে রপ্তানি খাতে অবদান যাচাইয়ের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পণ্যে প্রণোদনা দিতে পারে। তবে তা সরকারের উচ্চপর্যায়ে যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে হতে হবে।

‘সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে’

নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, ‘আমাদের মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক, আর রাজস্ব নীতি সম্প্রসারণমূলক। অর্থাৎ সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপ মুদ্রানীতির জন্য সহায়ক না। ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, শুল্কনীতি, সুদহার, বিনিময় হার—সব ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর কাউতে খুশি করতে নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে এটা করতে হবে।’ 

এ প্রসঙ্গে বিনায়ক সেন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সুদহার বাড়ানো বা এ রকম পৃথক পদক্ষেপ নিলে হবে না। এর সঙ্গে শুল্ক কমানোসহ সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় আমাদের বাজারভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, যে গতিতে আর্থিক নীতি বাস্তবায়ন করা হয়, একই গতিতে রাজস্ব নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ। তিনি বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। ব্যাংকগুলো এত দিন যেভাবে চলেছে, সেভাবে চলতে দিলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি উল্লেখ করে সাদিক আহমেদ বলেন, মালিকানার বিষয়টি ঠিক রেখে ব্যাংকগুলোতে করপোরেট ব্যবস্থাপনা চালু করা যেতে পারে।

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুষ্ঠানে উপস্থিত অর্থনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা সব সময় নরম ভাষায় কথা বলেন। এটা ভালো। কিন্তু যারা ঋণখেলাপি হচ্ছে, দিনদুপুরে ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে, তাদের সরাসরি ডাকাত বলবেন।’