গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমানের অবনতি হয়। কিন্তু এ সময় অনেক দেশে মজুরি বাড়লেও বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি দৃশ্যত বাড়েনি।
ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের তথ্য বলছে, গত এক বছরে বিশ্বের অনেক দেশেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আর্জেন্টিনা ও তুরস্কে ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে ১০০ শতাংশ। এমনকি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক সূচকে এগিয়ে থাকলেও পাকিস্তানে গত এক বছরে ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ভারতে বেড়েছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
শ্রমিকদের মজুরি যেন নির্দিষ্ট হারের চেয়ে কম দেওয়া না হয়, সে জন্য অনেক দেশেই ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হচ্ছে ৪৪ খাতে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচের স্তরের চেয়েও কম।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পে সর্বশেষ মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। তখন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার টাকা। এখন ডলারের বিনিময় হার ১০৫ টাকা ধরা হলে এই মজুরি দাঁড়ায় ৭৯ দশমিক ১৯ ডলার।
বাংলাদেশের ৮০ শতাংশের বেশি শ্রমশক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। শ্রমিকনেতাদের বক্তব্য, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
দেখা যাক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কত মজুরি দেওয়া হয়। ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের হিসাবে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মজুরি দেওয়া হয় ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গে—মাসিক ২ হাজার ১৪০ ডলার। এরপর দ্বিতীয় স্থানে আছে অস্ট্রেলিয়া, সে দেশের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ২ হাজার ২২ ডলার।
উন্নত দেশগুলোয় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবে সেসব দেশের ন্যূনতম মজুরিও বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ সাধারণত যেসব দেশের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে, তেমন অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশে ন্যূনতম মজুরি কম। যেমন ভিয়েতনামের ন্যূনতম মজুরি ১৬২ ডলার, ২০২৩ সালে যা বেড়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের ন্যূনতম মজুরি ১৪১ ডলার; এ বছর বেড়েছে ৯ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি ১৭৩ ডলার।
২০২২ সালে মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে তুরস্ক ও আর্জেন্টিনা। ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, তুরস্কের ৭০ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাধ্য হয়েই তাঁদের ন্যূনতম মজুরি শতভাগ বাড়াতে হয়েছে।
আর্জেন্টিনার অবস্থাও একই রকম। ২০২২ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ জেতা ছাড়া দেশটির অর্থনীতির জন্য আশাজনক কিছু দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি খুব বেশি সেখানে। এ কারণে তারা গত বছর তিনবার ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়েছে; সব মিলিয়ে মজুরি বেড়েছে শতভাগ।
বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা যে ন্যূনতম মজুরি পান, তা মানবিক জীবন যাপন করে শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের জন্য খুবই অপ্রতুল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে যতটা আয় প্রয়োজন, তার তুলনায় অর্ধেক আয় করেন দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা।
মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ—এই জোড়া ধাক্কায় দেশে পারিবারিক ব্যয় অনেক বেড়েছে, কিন্তু শ্রমিকদের আয় বাড়েনি। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের দুজন সদস্য কাজ করার পরও ব্যয় নির্বাহ করা যাচ্ছে না।
২০২১ সালের শেষ ভাগে এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ অ্যালায়েন্স (এএফডব্লিউএ) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সে সময় শ্রমিকদের পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় ছিল ২৪ হাজার ৩৭৩ টাকা। অথচ সামগ্রিকভাবে দুজনে কাজ করেও আয় হয় ২১ হাজার ৬৪২ টাকা। অর্থাৎ, প্রতি মাসেই তাদের ধার করে চলতে হচ্ছে। দেশের বিদ্যমান মজুরিকাঠামো তৈরি পোশাকশ্রমিকদের ঋণের চক্রে ঠেলে দিচ্ছে।
এএফডব্লিউএর সেই জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা দৈনিক মাত্র ১২০ টাকার বিনিময়ে ১ হাজার ৯৫০ ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করছেন। অথচ ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে গেলে একজন মানুষকে দিনে ২ হাজার ১২২ ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।
প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, পরিবারের ভরণপোষণ করতে ২০২২ সালে দেশের একজন শ্রমজীবী মানুষের মাসিক আয় হওয়া উচিত ছিল ৫১ হাজার ৯৯৪ দশমিক ৫১ টাকা। একজন মানুষের দৈনিক ৩ হাজার ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করতে হবে, সেই মানদণ্ডে মাসিক আয় এমন হওয়া উচিত বলে জানিয়েছে এফডব্লিউএ। তারা মনে করে, সুস্থ জীবনযাপনের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৩ হাজার ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন।