২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত উড়োজাহাজ ইজারার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে ইজারার ব্যয় কমবে। বাংলাদেশ বিমান ও বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো অনেক সময় উড়োজাহাজ ইজারা নিয়ে যাত্রী পরিবহন করে। উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে অগ্রিম কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার উৎপাদনকারীদের জন্য দুঃসংবাদ। সিলিন্ডার তৈরির দুটি কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) এবং ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। এলপিজি সিলিন্ডারের ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
বাইসাইকেলের কিছু যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বিদেশি যন্ত্রাংশ ব্যবহারকারী বাইসাইকেলের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। অবশ্য এসব যন্ত্রাংশ দেশেও তৈরি হয়। ফলে দেশি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে বাইসাইকেল উৎপাদন করলে ব্যয় বাড়বে না; বরং দেশীয় উৎপাদনকারীরা সুরক্ষা পাবেন।
আঠা (অ্যাডহেসিড/গ্লু) আমদানিতে ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে বিদেশি আঠার দাম বাড়বে। নানা শিল্পপণ্য উৎপাদনে আঠা লাগে। আবার বাসাবাড়িতে বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে আঠা কিনতে হয়। সব মিলিয়ে আঠা কিনতে বাড়তি খরচ হতে পারে এবারের বাজেটে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের কারণে।
ইট দেশে দুভাবে তৈরি হয়। একটি যন্ত্রের সাহায্যে, অন্যটি সনাতন ইটভাটায়। এবারের বাজেটে যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া তৈরি সাধারণ ইটে ভ্যাট (নন-রিফ্লেকটরি বিল্ডিং ব্রিকস) প্রতি হাজারে ৪৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এটা ‘ফেসিংয়ে’ ব্যবহৃত ইটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। ফলে ইটের দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
সফটওয়্যার ও কাস্টমাইজেশন সেবার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে এই সেবার মূল্য বাড়তে পারে। বিদেশি কিছু সফটওয়্যারের ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। অন্য ক্ষেত্রে হারটি ২৫ শতাংশ। শুল্ক ফাঁকি রোধে হারটি সব ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাটও বসবে।
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে লিফটের সরঞ্জামের আমদানিশুল্ক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিদেশি লিফটের দাম অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে। শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ হবে চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটর আমদানিতে।
ব্লেন্ডার, জুসার, প্রেশার কুকারের মতো গৃহস্থালি সরঞ্জাম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা আরও দুই বছর (২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) বহাল থাকবে। একই সুবিধা পাবে ওয়াশিং মেশিন এবং মাইক্রোওয়েভ ও ইলেকট্রিক ওভেন উৎপাদনকারী কারখানা। দেশীয় কারখানার জন্য এই সুবিধা বহাল রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
দেশেই এখন বেশির ভাগ রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার তৈরি হয়। দেশীয় ব্র্যান্ড এই বাজারে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। আবার বিদেশি ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনের কারখানাও দেশে হয়েছে। এসব কারখানার জন্য ভ্যাট ছাড় সুবিধা রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এখনকার মতো ৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকবে আরও এক বছর।
দেশে এখন স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার তৈরির বেশ কিছু কারখানা হয়েছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রতিষ্ঠিত এসব কারখানায় উৎপাদিত ন্যাপকিন ও ডায়াপার বাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। এসব কারখানার জন্য কাঁচামাল আমদানিতেও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আরও এক বছর বহাল রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে কম্পিউটার প্রিন্টার, টোনার কার্টিজ/ইঙ্কজেট কার্টিজ, কম্পিউটার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নোটবুক, নোটপ্যাড, ট্যাব, সার্ভার, কি–বোর্ড, মাউস ইত্যাদি নানা পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনে রেয়াতি সুবিধা তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করছাড় সুবিধা থাকবে। ফলে সুফল পাবেন দেশীয় উৎপাদকেরা।
দেশে বিদেশি ব্র্যান্ডের সাবান উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। আবার দেশীয় ব্র্যান্ডের সাবানও জনপ্রিয়। সাবান ও শ্যাম্পুর দুটি কাঁচামালে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত যে ভ্যাট রয়েছে, তার অব্যাহতি সুবিধা এক বছর বহাল রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
স্যান্ডউইচ প্যানেল ভবনে ব্যবহার করা হয় তাপ ও শব্দপ্রতিরোধক হিসেবে। পণ্যটি মূলধনি যন্ত্রপাতি হিসেবে রেয়াতি সুবিধায় মাত্র ১ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে আমদানির সুযোগ রয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পণ্যটি কোনো মূলধনি যন্ত্রপাতি নয়। দেশে এটি তৈরি হয়। তাই পণ্যটির আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সরকার ক্যানসার চিকিৎসার খরচ কমাতে ক্যানসারের ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে রেয়াতি সুবিধাভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে বাজেটে। আগেও ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদনে করছাড় দেওয়া হয়েছে। এবার সেই তালিকায় আরও কিছু কাঁচামাল যুক্ত হয়েছে। দেশে বেশ কিছু কারখানায় ক্যানসারের ওষুধ তৈরি হয়।
দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী অনেক। এ রোগ হলে নিয়ম মেনে চলতে হয়। পাশাপাশি ওষুধ খেতে হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সুখবর এল বাজেটে। ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা ও ওষুধ তৈরির কতিপয় কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বাজেটে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে ওষুধের দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন বিশ্বে ৩৫তম। ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার একটি জায়গায় এই তথ্য জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, একসময় বিশ্বের দরিদ্রতম ১০টি দেশের মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির দেশ হয়েছে।
করজাল বাড়াতে এবং কর ফাঁকি রোধ করতে লেনদেন ব্যাংকব্যবস্থায় আনায় জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সব ধরনের আয় ও প্রাপ্তি এবং প্রত্যেক একক লেনদেনে পাঁচ লাখ টাকার অধিক ও বার্ষিক সর্বমোট ৩৬ লাখ টাকার বেশি সব ধরনের ব্যয় ও বিনিয়োগ অবশ্যই ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে সম্পাদন করার বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
দেশে এখন মাইক্রোওয়েভ ওভেন তৈরি হয়। তবে বিদেশ থেকেও আমদানি হয়। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মাইক্রোওয়েভ এবং অন্যান্য ধরনের ওভেন আমদানিতে মোট করভারের পার্থক্য রয়েছে। সব ধরনের ওভেনে করভার ৮৯ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে কিছু কিছু ওভেনের দাম বাড়বে।
আগামী বাজেটে প্রক্ষেপিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় প্রক্ষেপিত প্রত্যক্ষ কর ব্যয় (কর অব্যাহতি) হিসাব করা হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ভর্তুকি যদি কর হিসেবে আদায় হতো, তাহলে মোট আহরিত করের সঙ্গে এটি যুক্ত হতো।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, মেরামত, সংরক্ষণ বা পরিচালনার জন্য কেনা পণ্যের জন্য কর অব্যাহতির আবেদন করা যাবে না। এর পরিবর্তে খাতভিত্তিক করের হিসাব করে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রকল্প বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাজেট বক্তৃতায় এই নিয়মের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বরাদ্দ থেকেই শুল্ক ও কর পরিশোধ করতে হবে।
মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস), ব্যাংক ও ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও বিদ্যুৎ বিল দেওয়া যায়। কিন্তু বিল প্রদানের পরে এসব প্রতিষ্ঠানের ইস্যু করা ‘ইনভয়েস’ অনেক ক্ষেত্রে চালান হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানের ইস্যু করা বিদ্যুৎ বিলের ‘ইনভয়েসকে’ চালান হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্রের মাধ্যমে ৮০ হাজার তরুণকে অগ্রসর প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে সরকার। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘তরুণেরা নিজের ও সমাজের জন্য পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে, আমাদের তরুণদের মধ্যে আমরা সে ধরনের প্রণোদনার সঞ্চার করতে চাই।’
করোনাকালে সরকার ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ হাতে নিয়েছিল। অর্থমন্ত্রী এবার এসব প্রণোদনার সুফলভোগীর একটি সংখ্যা জানালেন। তিনি বলেছেন, এ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফলভোগীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৬৫ লাখ ৩৫ হাজার ব্যক্তি এবং প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার প্রতিষ্ঠান।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, স্মার্ট বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। বর্তমান বিনিময় মূল্যে পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ লাখ টাকার বেশি (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা ধরে)। সে সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়।
অনলাইনে পণ্য বিক্রির এখনকার সংজ্ঞায় শুধু রিটেইল বা খুচরা কেনাবেচাকে বোঝানো হয়েছে। এই সংজ্ঞায় অনলাইন মার্কেটপ্লেসের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। অনলাইনে পণ্য বিক্রির সংজ্ঞায় ‘মার্কেটপ্লেস’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার কথা বলা হয়েছে বাজেটে।
আমদানির সময় শুল্ককর আরোপের জন্য বিভিন্ন পণ্যের একটি ন্যূনতম মূল্য ধরা হয়, যাকে বলা হয় ট্যারিফ ভ্যালু। আমদানি মূল্য যতই হোক না কেন, শুল্ককর দিতে ট্যারিফ ভ্যালু ধরে। বাজেটে ৪০টি পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালু তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পোশাক, রেজর, মশার কয়েলসহ অনেক কিছু।