কালোটাকার সুযোগ আর কত

স্বাধীনতার ৫০ বছরে ২১ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে সুযোগটি মেলে ৪০ বছর। কিন্তু তেমন সাড়া মেলেনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম গত বুধবার সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এক প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘শেয়ারবাজারের কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিলেই বাজার চাঙা হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।’ তিনি সত্যি কথাই বলেছেন। কারণ, তাঁর আমলেই গত দুই অর্থবছরে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সাড়া একদম কম।

২০২০-২১ অর্থবছরে ২৮৬ জন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ জন করদাতা এই সুযোগ নিয়েছেন। এতে সব মিলিয়ে ৪৩০ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে গেছে। বাজারও আশানুরূপ চাঙা হয়নি।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এ পর্যন্ত মোট ২১ বার নানাভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে সুযোগটি মিলেছে ৪০ বছর। সাধারণত দেশের অভ্যন্তরে উপার্জিত কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেওয়া হয় দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ। কিন্তু এখনো সুযোগটি কেউ নেননি।  

বারবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সমাজ একটি বার্তা দেয় যে ‘তুমি দুর্নীতি করো, আমি বৈধ করে দেব’। তাই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতি সহায়ক।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।

বছরের পর বছর এই সুযোগ দিয়েও তেমন সাড়া পায়নি সরকার। অর্থাৎ কালোটাকা সাদা করার সুযোগগুলো কার্যত অকার্যকরই দেখা গেছে। আবার কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধেও কোনো  ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আলাপকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। তবে কোনো দেশই বাংলাদেশের মতো ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’-এর ব্যবস্থা করেনি। ওই সব দেশ কয়েকবার স্বল্প সময়ের জন্য সুযোগটি দিয়েছে। তাদের এই নাগরিকেরাও সুযোগ লুফে নেন। কারণ, সুযোগ না নিলে শাস্তি প্রদানের হুমকিও দিয়ে রেখেছিল সেই সব দেশ। অথচ বাংলাদেশে ঢালাওভাবে এবং প্রায় সব সময় সুযোগ দেওয়া হলেও এর সুফল মেলে না। কারণ, কালোটাকার মালিকেরা মনে করেন, এই সুযোগ ভবিষ্যতে আরও মিলবে।

দেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে ৫ থেকে ২০ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর বাইরে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি ক্রয় এবং শেয়ারবাজার ও শিল্প খাতে বিনিয়োগের বিপরীতেও এই সুযোগ মিলে ছিল।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নৈতিকতার সঙ্গে সমঝোতা করে কালোটাকার সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ তেমন কর আদায় হয় না। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘বারবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সমাজ একটি বার্তা দেয় যে “তুমি দুর্নীতি করো, আমি বৈধ করে দেব।” তাই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতি সহায়ক। আবার ক্ষমতাবানদের জন্য এই সুযোগ দেওয়া হলেও তাতে সাড়া মেলে না।’

৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে

১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার প্রথমবারের মতো কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেন। ওই সময়ে এক শ টাকার নোট বাতিল করা হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান তাঁর সামরিক শাসনামলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেন। পরে একে একে এরশাদ সরকার, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার (১৯৯৬-২০০১), বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার (২০০১-২০০৬), তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-০৮) এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদেই সুযোগটি দেওয়া হয়। শুধু ১৯৯১-৯৬ সালের বিএনপি সরকারের আমলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রথম বাজেট বক্তৃতায় এই ধরনের সুযোগ না দেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু পরের মেয়াদে (২০০১-০৬) তিনি কথা রাখতে পারেনি।

এনবিআরের সূত্রগুলো বলছে, এই পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, মানে সাদা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ১৫ বছরে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আওয়ামী লীগের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে।

কেন দুবার বেশি সাদা হয়

সাধারণত সাদামাটা ঘোষণায় কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু সুযোগ না নিলে কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা বলা হয় না। অবশ্য জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তেমন সাড়া মেলেনি।

এরপর ২০০৬-০৭ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। প্রকাশ করেছিল সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা। ওই বছর প্রায় ৩২ হাজার করদাতা ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সাদা করেন। মূলত ভয়েই তখন প্রচুর মানুষ সুযোগটি নেন।

২০২০-২১ অর্থবছরে এযাবৎকালের এক বছরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়। সেবার জমি-ফ্ল্যাট কিনে ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা নগদ টাকা সাদা করেছেন ১১ হাজার ৮৫৯ জন ব্যক্তি। কর কর্মকর্তারা জানান, কোভিডের কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সীমিত হওয়ায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন বেশি।

কারও শাস্তি হয়নি

কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ শেষ হওয়ার পর এনবিআর কালোটাকার মালিকদের ধরতে কোনো উদ্যোগও নেয়নি, কাউকে ধরেও কোনো শাস্তি দেয়নি। অথচ আয়কর অধ্যাদেশে অপ্রদর্শিত আয় ধরা পড়লে জরিমানা করার বিধান আছে। তবে তা বৈধ উপায়ের আয় হতে হবে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ সম্পর্কে আয়কর অধ্যাদেশে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু বলা নেই।

অবশ্য মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর অর্থ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত এনেছিল বর্তমান সরকার। এ থেকে বোঝা যায়, কালোটাকা কিংবা পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে চাইলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

কত কালোটাকা আছে

বাংলাদেশে কত কালোটাকা আছে, তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছে। তবে দিন দিন অর্থনীতিতে কালোটাকার পরিমাণ বেড়েছে—তা ওই সব গবেষণায় উঠে এসেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে ১৯৭৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭ শতাংশের সমপরিমাণ কালোটাকা ছিল। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ কালোটাকা বিরাজমান ছিল। ২০১০ সালে তা সর্বোচ্চ প্রায় ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল।

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মকর্তা লিয়ান্দ্রো মেডিনা ও অস্ট্রিয়ার অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডার ‘শেডিং লাইট অন দ্য শ্যাডো ইকোনমি: এ গ্লোবাল ডেটাবেজ অ্যান্ড দ্য ইন্টারঅ্যাকশন উইথ দ্য অফিশিয়াল ওয়ান’ নামে একটি গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গড়ে জিডিপির ৩৩ শতাংশের মতো কালোটাকা ছিল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী জিডিপির ৩ ভাগের ১ ভাগ পরিমাণও যদি কালো টাকা থাকে, তা ১০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অথচ ২১ বার সুযোগ দেওয়ার পর ২০ ভাগের ১ ভাগ কালোটাকাও সাদা হয়নি।