ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন আইন পাস হয়েছে ১০ মাস আগে। এ আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানোর কথা বলা আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানতে চেয়েছে কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে কি না। সংস্থাটির প্রতিনিধিদল এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছে।
পাশাপাশি হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১; দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭; এবং অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ নতুন করে করার কথা যে বলে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, তার হালনাগাদ চিত্রও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফকে জানানো হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন আইনের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনও নতুন ভাবে করা হয়েছে। বাকি আছে তিনটি।
সচিবালয়ে আজ বৃহস্পতিবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদল এসব কথা জানতে চেয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। আইএমএফের গবেষণা বিভাগের সামস্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। আইএমএফের বাংলাদেশ কার্যালয়ের আবাসিক প্রতিনিধি জয়েন্দু দে এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বাংলাদেশের দিক থেকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আফজাল করিম, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মুর্শেদুল কবীর ও রূপালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন বিভাগের তিন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আইএমএফের দলটির বৈঠক চলবে আগামী ৮ মে পর্যন্ত।
আইএমএফ ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। এ সময় অন্য অনেক শর্তের মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ পাঁচটি আইন প্রণয়নের শর্ত দেওয়া হয়। এসব আইন প্রণয়নের দায়িত্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের। অন্য শর্তের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকে তা ৫ শতাংশের কম রাখা।
ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তিতে ৭০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা আগামী মাসে। তার আগে পর্যালোচনা বৈঠক করতে ঢাকায় আসা আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করে গত বুধবার।
বৈঠকে জানানো হয়েছে, দেউলিয়া আইনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরিবর্তে আইন মন্ত্রণালয় করবে। আর অন্য দুটি এখনো খসড়া পর্যায়ে আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বৈঠকে খেলাপি ঋণসহ রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের সাম্প্রতিক চিত্র, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকগুলোকে দেওয়া পুনঃ মূলধন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটচিত্র এবং ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরেছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাসহ সংস্কার পরিকল্পনাও জানিয়েছে বিভাগটি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ সময় বলেছে, খেলাপি ও অবলোপন থেকে ঋণ ভালো আদায় হচ্ছে না। এমনকি চার ব্যাংকের নিট মুনাফাও দুই হাজার কোটি টাকার বেশি নয়। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা এবং সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। আইএমএফের প্রতিনিধিদল তথ্য-উপাত্ত নিয়েছে এবং খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনার কৌশল নির্ধারণ করতে তাগিদ দিয়েছে।
বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতের যথাযথ সংস্কার নিয়ে আইএমএফ যা বলছে আর যা বলবে, তা আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। কিন্তু সরকার করছে না।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন আইন হয়েছে ভালো কথা। কিন্তু ব্যাংকে পরিবারের আধিপত্য রয়েই গেছে। নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিয়েছে কোনো শিল্পগোষ্ঠীর এক কোম্পানি খেলাপি হলেও অন্য কোম্পানি ঋণ পাবে—এটা তো ভয়ংকর নীতি সিদ্ধান্ত। ব্যাংক খাতে সংকট এতটা গভীর যে এখন এক ব্যাংককে আরেক ব্যাংকের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে (একীভূত) সমাধানের চেষ্টা চলছে। এভাবে এ খাতের সংস্কার হবে না, লাগবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা।