নাজমা মোবারেক
নাজমা মোবারেক

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থাকছে, আজ নিয়োগ হলো নতুন সচিব

সচিব নিয়োগে দেরি হওয়া নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই আশঙ্কা ছিল, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগটিই শেষ পর্যন্ত তুলে দেয় কি না ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। আগের মতো এটিকে অর্থ বিভাগের একটি অনুবিভাগে পরিণত করার দাবি তুলেছিল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

তবে কর্মকর্তাদের আশঙ্কা সত্যি হয়নি। সিপিডির দাবিও আমলে নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। প্রায় আড়াই মাস পর বিভাগটি নতুন সচিব পেল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আজ বুধবার মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেককে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে বদলির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

নাজমা মোবারেক বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ত্রয়োদশ ব্যাচের কর্মকর্তা। দীর্ঘ সময় অর্থ বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে ২০২৩ সালের ৬ জুন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী এই কর্মকর্তা পরে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক ইকোনমিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফিন্যান্সে এমএসসি ডিগ্রি নেন।

বিভাগটির শেষ সচিব ছিলেন মো. আবদুর রহমান খান, যিনি বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান। আবদুর রহমান খান আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন তিন মাস (১৯ মে থেকে ১৯ আগস্ট)। তিনি এই বিভাগের নিয়মিত সচিব ছিলেন গত ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। গত ১৬ মে আগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যান।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ১০ দিনের মাথায় আবদুর রহমান খানকে এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ১৫ আগস্ট ভিন্ন এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় সরকার। পাঁচ দিনের মাথায় গত ২০ আগস্ট অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মফিদুর রহমানকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরদিন ২১ আগস্ট এ প্রজ্ঞাপনও বাতিল করা হয়। ওই দিন নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভাগেরই অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডলকে। সেই থেকে ২ মাস ৯ দিন ধরে তিনি এ বিভাগ সামলাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ), সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার কাজটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ করে থাকে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ইত্যাদি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়োগও এ বিভাগই দেয়; যদিও শর্ত হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অনুমোদন সাপেক্ষে’ নিয়োগ দিতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার নজির নেই বললেই চলে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

কীভাবে হলো এ বিভাগ

১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রথমবার ব্যাংকিং বিভাগ চালু করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একসময় নাম ছিল ব্যাংকিং বিভাগ। প্রথম সচিব ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা। এরপর সচিব হন শাহ আবদুল হান্নান ও সৈয়দ আমীর উল মূলক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে ব্যাংকিং বিভাগ বাতিল করা হয়। এটিকে করা হয় তখন অর্থ বিভাগের ব্যাংকিং অনুবিভাগ। এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত এটি অনুবিভাগ হিসেবেই কাজ করে।

নতুন করে এ বিভাগ ফিরিয়ে আনে আওয়ামী লীগ সরকারই এবং তা এক যুগ পর। ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠন করা হয় নতুন বিভাগ। এবার নাম দেওয়া হয় ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’। গঠনের এক মাস পর, অর্থাৎ ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে বৈঠক করে জানিয়ে গিয়েছিল, বিভাগটি গঠিত হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব হবে বলে তাঁদের আশঙ্কা। যুক্তি হচ্ছে, বিদ্যমান ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যেকোনো নির্দেশনা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ।

বিভাগটি গঠন করার আগে অর্থ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আর্থিক খাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কাজে গতিশীলতা আনার যুক্তি দিয়ে ওই কমিটি তখন প্রতিবেদন দিয়েছিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে। পরে তৎকালীন মন্ত্রিসভা কমিটি এ প্রস্তাব অনুমোদন করে। তবে বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়। প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে উত্থাপিত হলে কমিটির সদস্যদের নজরে আসে, কার্যপ্রণালি বিধিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্পর্কে কিছু বলা নেই। সচিব কমিটির বৈঠকে তখন কার্যপ্রণালি বিধিমালার সংশোধনী আনা হয়, পরে অনুমোদন করে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়।

২০১০-এ প্রথম সচিব ও অনেক প্রশ্ন

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গঠিত হওয়ার পর প্রথম সচিব হন শফিকুর রহমান পাটোয়ারী। ২০১০ সালের ২১ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বিভাগটির প্রথম সমন্বয় সভায় তিনি জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর্মসম্পাদন নির্দেশক তৈরি করে দেওয়া হবে এ বিভাগ থেকে। তাদের পর্ষদসভার কার্যবিবরণী পাঠাতে হবে এ বিভাগে। শুধু তা-ই নয়, কার্যবিবরণীর সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হবে পর্ষদের নেওয়া উল্লেখযোগ্য বিষয় ও সিদ্ধান্তের সংক্ষিপ্তসার। ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, সচিব বলেছিলেন, নতুন বিভাগের কার্যপ্রণালি বিধিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যাবতীয় কার্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় রাজনৈতিক নেতা ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ এ বিভাগ থেকেই করা হয়। শফিকুর রহমান পাটোয়ারী সচিব থাকার সময়ই সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি হয়। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের সময়ও তিনি এ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। দলীয় লোক অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির নেতাদেরও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেওয়ার কাজটি তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেওয়ার কাজটিও তাঁর সময়েই হয়, যদিও এটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

অন্য সচিবেরা কী করে গেলেন

শফিকুর রহমান পাটোয়ারী অবসরে যাওয়ার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে এ বিভাগে সচিব হিসেবে আসেন এম আসলাম আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর ২০১৬ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গে তাঁকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। তিন বছরের বেশি সময় বিভাগটির সচিব ছিলেন তিনি। ব্যাংকগুলোর পর্ষদে বিতর্কিত, অযোগ্য ও দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার ধারাবাহিকতা তাঁর সময়েও বজায় থাকে। তবে দলীয় পরিচালক নিয়োগ অনেক কমে যায় তখন।

এরপর মার্চ মাসেই বিভাগটিতে সচিব হিসেবে নিয়োগ পান মো. ইউনুসুর রহমান। তাঁর সময়ে ২০১৭ সালের মে মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নাম বদলে রাখা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ২০১৮ সালের আগস্টে অবসরে যান তিনি। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েমের পথ সুগম হয় তাঁর সময়ে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন থাকার বিধান ছিল। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এক পরিবারের চার সদস্যের থাকার সুযোগ দেওয়া হয় পর্ষদে।

ওই বছরের আগস্টে বিভাগটির সচিব হিসেবে যোগ দেন আসাদুল ইসলাম, যিনি প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার একান্ত সচিব ছিলেন। তাঁর চাকরি ছিল এক বছর। ২০১৯ সালে তাঁকে আরও দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২১ সালের আগস্টে তিনি অবসরে যান। তিনি কিছু আইন সংশোধন ও কিছু নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও বেশির ভাগই শেষ করতে পারেননি।

এরপর আসেন শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, যিনি পদত্যাগী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তিনি অবসরে গেছেন ২০২৪ সালের মে মাসে। তাঁর সময়ে ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবার সংশোধন করা হয়। এবার বিস্ময়করভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয় ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ। পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর নিয়েই যেখানে বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা ছিল, আইন সংশোধন করে তা করা হয় টানা ১২ বছর।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত ১২ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কারণে ব্যাংক খাতে দ্বৈত শাসনের সুযোগ তৈরি হয়। তাই বিভাগটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।