কালুরঘাট সেতু
কালুরঘাট সেতু

চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহনে আসবে গতি, নিরবচ্ছিন্ন হবে রেল চলাচল

  • মোট ব্যয়—১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা

  • সরকারি অর্থায়ন—৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা

  • বিদেশি সহায়তা—৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকা

  • মূল সেতুর দৈর্ঘ্য—৭০০ মিটার

  • রেলপথের দৈর্ঘ্য হবে—১১.৪৪ কিলোমিটার

  • সেতুতে থাকবে—দুই লাইনের রেলপথ এবং দুই লেনের সড়কপথ

চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীতে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এ জন্য সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। একের পর এক সরকার পরিবর্তন হলেও এত দিন মানুষের সেই দাবি পূরণ হয়নি। অবশেষে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার এ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর একটি প্রকল্প। কখনো যদি মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়, তাহলে কালুরঘাট সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ও সড়কপথে পরিণত হবে।
মইনুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন সেতু নির্মিত হলে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক ও রেলপথে যাতায়াত আরও সহজ ও নির্বিঘ্ন হবে। দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব রাখবে এই সেতু। কেননা কক্সবাজারে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে তখন পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠবে কালুরঘাটের এই সেতু। এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান রেল ও সড়কসেতুটি ১৯৩১ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। ৬৩৮ মিটার দীর্ঘ সেতুটি ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় সেতুটি সংস্কার করেছিল রেলওয়ে। এরপর গত বছরের ১ আগস্ট থেকে বড় ধরনের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছিল। তাতে এটি ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। তবে গাড়ি চলাচল আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়নি।

পণ্য পরিবহনে হবে রেল করিডর

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চালু হয়েছে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচল। তবে রেল চলাচলে এখনো বড় প্রতিবন্ধকতা কালুরঘাটের ৯৩ বছরের পুরোনো রেলসেতু। এই সেতু দিয়ে ১০ থেকে ২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চালানো যায় না।

রেলওয়ের কর্মকর্তা ও প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, সেতুটি নির্মিত হলে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে রেল করিডর তৈরি করা হবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজারে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ ও বাধাহীন হবে। এ ছাড়া আন্ত–আঞ্চলিক বাণিজ্য সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের জীবনমানেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

চট্টগ্রামের কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ভালো প্রকল্প বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এটি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। অর্থনৈতিকভাবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর একটি প্রকল্প। ইতিমধ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এখন সেতু হবে। আর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে কক্সবাজার রেললাইনের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। আর কখনো যদি মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়, তাহলে কালুরঘাট সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ও সড়কপথে পরিণত হবে।

এদিকে গত বছরের ১১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন। সাগর থেকে এই টার্মিনালে জাহাজ আনা-নেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে আগেই। আর টার্মিনাল চালু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৬ সালে।

প্রকল্পের অধীনে যা হবে

রেলওয়ে সূত্র জানায়, কালুরঘাটে সড়ক ও রেলসেতু নির্মাণে ২০১৮ সালে এক দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থায়ন ও নকশা চূড়ান্ত হলেও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আপত্তিতে পড়ে তা আটকে যায়। এরপর উচ্চতা–জটিলতা দূর করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০২২ সালে। তখন পদ্মা সেতুর আদলে কালুরঘাটে সেতুর প্রাথমিক নকশাও তৈরি করা হয়েছিল। এই নকশা অনুযায়ী ওপরের তলায় গাড়ি ও নিচে রেল চলার কথা ছিল। তবে নকশা নিয়ে তৎকালীন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে ওই সময় আর প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। ওই নকশা অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।

তবে এবার প্রায় সব ধরনের জটিলতা দূর করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। নতুন সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে খরচ করা হবে ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অর্থায়ন করা হবে ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) এবং কোরিয়ার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এই অর্থায়ন করবে।

প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, নদীর ওপর মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। এই ছাড়া দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) নির্মাণ করা হবে ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার। বাঁধ নির্মাণ করা হবে ৪ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার। সড়ক ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হবে ২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এ ছাড়া ১১ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে প্রকল্পের আওতায়। কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাটে বিদ্যমান সেতুর ৭০ মিটার উজানে এই সেতু নির্মাণ করা হবে। এতে দুই লাইনের রেলপথ এবং দুই লেনের সড়কপথ থাকবে।

কালুরঘাট সেতু নির্মাণসংক্রান্ত ফোকাল কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের পর এখন পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। বিশদ নকশা করার পর দরপত্র আহ্বান করা হবে। ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এর আগেই ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়ে যাবে।