বাজেটের ব্যয় মেটাতে সরকারের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের জন্যও সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে যাচ্ছে। আগামী বাজেট হতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থই আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ হিসেবে। ঋণের পরিমাণ হতে পারে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো।
বাজেট তৈরির সময় সরকার ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা প্রায় প্রতি অর্থবছরেই মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশের কিছুটা বেশি রাখে। এবারই এ লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশের নিচে রাখা হচ্ছে। তারপরও ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে, যা মেটাতেই বিপুল ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করছে সরকার। ঋণের বেশির ভাগ অর্থই আসবে আবার দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বাজেট প্রণয়নের মূল দায়িত্বে থাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজেট–ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি এবং দেশি বা অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের উৎস হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ। অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই ব্যাংকঋণ, চলতি অর্থবছরে যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বাকি ঋণ সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
আগামী অর্থবছরে মোট ঋণের মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে দেশি ঋণ। দেশি ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য উৎস থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি প্রকাশ করেছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ছিল ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি ৭ হাজার ৯৭৯ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারকে ১১৭ টাকা ধরে হিসাব করলে তা ৯ লাখ ৩২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি এত বড় হওয়ার কারণেই সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে আগামী বাজেটে। আগামী অর্থবছরে ঋণের সুদ বাবদ বরাদ্দ রাখতে হবে ১ লাখ টাকা কোটি টাকার বেশি, যার বড় অংশই ব্যয় হবে দেশি ঋণের সুদ পরিশোধে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকাকে ঝুঁকিমুক্ত বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ হার বর্তমানে ৩৭ শতাংশেরও বেশি। এ হার এখনো ঝুঁকিমুক্ত থাকলেও রাজস্ব আয় সংগ্রহে ভালো গতি না থাকায়, ১০ মাসের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তেমন ভালো না হওয়ায় (প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ), প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) আশানুরূপ চিত্র দেখা না যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা কিছুটা চিন্তিত। ডলারের দাম এখনো সন্তোষজনক মাত্রায় স্থিতিশীল না হওয়ার বিষয়টি তাঁদের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই কারণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়া খারাপ। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, যে চাপ শেষ পর্যন্ত বহন করতে হয় ভোক্তা অর্থাৎ জনগণকে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে মিটিয়ে থাকে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী টাকা ছাপালে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়, যার পরিণতিতেই ঘটে মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার গত এপ্রিলে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে। ফলে টানা ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি যত বেশিই থাকুক না কেন, সরকারের হাতে আপাতত ব্যাংকঋণের কোনো বিকল্প নেই।
তবে অর্থ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার পুরো ঋণ নেয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ঋণের ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনেও এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, তার মধ্যে আট মাসে সরকার ঋণ নিয়েছে ২৪ হাজার ৯৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ দুটি বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঋণ সরকারের লাগবেই। রাজস্ব সংগ্রহ ভালো থাকলে হয়তো সরকারকে এত পরিমাণ ঋণ নিতে হতো না। তবে বিনিয়োগের অবস্থা যেহেতু ভালো না, এ অবস্থায় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিবর্তে সঞ্চয়পত্রকে বেছে নেওয়া যায়।
মাহবুব আহমেদ আরও বলেন, দুই বছর ধরেই সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি নেতিবাচক। ব্যাংকের সুদের হার এবং ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার এখন সঞ্চয়পত্র থেকেও বেশি। মোট কেনার সীমা ৫০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ বা ১ কোটি টাকা করা এবং মুনাফার হার আরেকটু বাড়িয়ে সঞ্চয়পত্রের প্রতি জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে সরকার।
জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি—এই আট মাসে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের মোট লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার মধ্যে সরকার এই সময়ে ঋণ নিয়েছে মোট ৩৬ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো বছরের জন্য সরকারের যা পরিকল্পনা আছে, তার ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ আট মাসে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। তবে অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, প্রতিবারই অর্থবছরের শেষ দিকে সরকার ব্যাংকঋণ বেশি নেয়। বেশি নেয় মে-জুন মাসে, আর সবচেয়ে বেশি নেয় জুন মাসে। এবারও তা–ই হবে।
এদিকে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি নেতিবাচক। অথচ চলতি অর্থবছরে সরকার পরিকল্পনা করেছিল এ খাত থেকে নিট ১৮ হাজার কোটি টাকা আসবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির নেতিবাচক চিত্রের কারণে জুন শেষে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ঋণ নিয়ে পূরণ করতে হচ্ছে। এমনকি আদায় করা রাজস্বের একটা অংশও ব্যয় হয়ে যায় ঋণ শোধে। প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১৪ শতাংশের মতো সুদ দিতে হলে আগামী অর্থবছরে সুদ ব্যয় অনেক বাড়বে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নিলে বেসরকারি খাতকে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়, আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপানো থেকে কিছুটা সরে এলেও ঋণের টাকার যথাযথ ও সাশ্রয়ী ব্যবহার হচ্ছে কি না এবং বেসরকারি খাত প্রণোদিত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে আগামী অর্থবছরে সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে কর্মসংস্থান কমবে ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যা জনগণের জন্য হবে নেতিবাচক।’