দেশের কর-জিডিপির অনুপাত কম। এর পাশাপাশি বড় সমস্যা হচ্ছে সরকারের রাজস্ব আয়ের যে প্রবৃদ্ধি, তার চেয়ে ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি বেশি। সরকার কোন খাতে কত ব্যয় করছে, তা দেখলে বোঝা যায় তার চরিত্র কী। গত অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় কমলেও কোভিডের পর থেকে সরকারের ভর্তুকি ও অনুদান ব্যয় বাড়ছে। রাজস্ব আয়ের বড় অংশ যাচ্ছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে।
ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের বিশেষ ওয়েবিনার ‘বাজেট ২০২৪-২৫: কেমন হবে অর্থনীতির আগামী দিন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি পলিসি অ্যানালিসিস সেন্টারের আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক জ্যোতি রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মনির হায়দার।
জ্যোতি রহমান বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারের সবচেয়ে বেশি ব্যয় বেড়েছে এসজিটি খাতে, অর্থাৎ সাবসিডি, গ্র্যান্ট ও ট্রান্সফার খাতে বা ভর্তুকি, অনুদান ও স্থানান্তর বাবদ। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে এই খাতে জিডিপির ১ শতাংশ পরিমাণ ব্যয় বেড়েছে। এই প্রবণতা আরও কয়েক বছর অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
সরকারের ব্যয় খাত বিশ্লেষণ করে জ্যোতি রহমান বলেন, সরকারের যা রাজস্ব আয় হয় তার ২০ শতাংশ ব্যয় হয় সুদ পরিশোধে; এই হার কয়েক বছর ধরে স্থিতিশীল আছে। এটা বাড়ছে না। সরকারের বেতন-ভাতায় ব্যয় হয় ২০ শতাংশের মতো; এই হার কমছে। অন্যান্য অনুন্নয়ন ব্যয় গত দুই বছরে কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে তা খুব একটা বেশি নয়। ব্যয় বেড়েছে এসজিটি খাতে; রাজস্ব আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ এই খাতে ব্যয় হচ্ছে।
২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ভর্তুকি, প্রণোদনা ও অর্থ স্থানান্তরে যে ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে, তার অর্ধেক গেছে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ। এই সময় ভর্তুকি ব্যয় বেড়েছে ৪২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা; এর মধ্যে ২৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা গেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে।
২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রণোদনা বাবদ ব্যয় বেড়েছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা; এর মধ্যে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা গেছে কৃষি খাতে। জ্যোতি রহমান বলেন, এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। সামগ্রিকভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে বাজেট ঘাটতি বাড়তে শুরু করেছে। মূলত উন্নয়ন বাজেট বৃদ্ধির কারণে তখন তা বেড়েছে। আগামী কয়েক বছরে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ হবে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও অনুদান।
জ্যোতি রহমান আরও বলেন, সরকার সাধারণত জনতুষ্টিবাদী নীতির কারণে গরিবের ভাত মারতে চায় না। কিন্তু অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মনির হায়দার বলেন, এখন সরকারের যে পরিস্থিতি, তাতে সেই কথা সম্ভবত আর বলার উপায় নেই। সরকার এখন যেসব নীতি প্রণয়ন করছে তার জেরে মূল্যস্ফীতি কমছে না বরং বাড়ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, অনেক দেশেই সরকার জনতুষ্টিমূলক পদক্ষেপ নেয়, সে জন্য জাতীয়তা ও ধর্মের মতো হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা থাকে তাদের। কিন্তু বাংলাদেশের বাজেটে সেই চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
জাহেদ উর রহমান আরও বলেন, সরকার মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করলে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বাড়াত বা নতুন করে আরও কিছু মানুষকে এই ভাতার আওতায় নিয়ে আসত। এসব ভাতা সামান্য পরিমাণে বাড়ানো হলে সরকারের ব্যয় খুব একটা বাড়ত না। সেই সঙ্গে দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সেই বিবেচনায় সরকার ন্যূনতম আয়কর সীমা কিছুটা বাড়াতে পারত, কিন্তু তা করা হয়নি।
জাহেদ উর রহমান মনে করেন, গোষ্ঠী শাসনে সরকার না চাইলেও কার্যত গরিবের ভাত মারা যায়। দেশে বিদ্যুতের চাহিদার দ্বিগুণ উৎপাদন সক্ষমতা আছে। তারপরও এই খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে। এ ধরনের কাজেই কার্যত গরিবের ভাত মারা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর দেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেন। তাঁর মতে, দেশে এখন ওয়ান পার্টি ডমিনেন্ট সিস্টেম বা এক দলের প্রাধান্যবিশিষ্ট সরকারব্যবস্থা চলছে; এই ব্যবস্থায় বাজেট কীভাবে হয় বা কার জন্য হয়, তা বোঝা দরকার।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আগে রাস্তা বা উন্নয়নকাজ করে কমিশন নিতে হতো; এখন আরও সহজে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে বখরা পাওয়া পাচ্ছে। তিনি বখরা শব্দটিতে বিশেষ জোর দেন। বলেন, বখরা ঠিক দুর্নীতি বা কমিশন খাওয়ার মতো নয়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারকে একটি গোষ্ঠীকে বখরা দিতে হচ্ছে। সে জন্য বিদ্যুৎ খাতে এত ভর্তুকি। এতে বোঝা যায়, সরকারের জনভিত্তি কমছে। এখন আর তাকে রাস্তা করতে হচ্ছে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন অনুষ্ঠানের আলোচক প্যানেলে ছিলেন না। তিনি অনুষ্ঠান শুনছিলেন। সঞ্চালক মনির হায়দার তাঁকে কিছু বলার অনুরোধ করলে ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজনৈতিক জবাবদিহি না থাকলে যা হয়, দেশে এখন ঠিক তা-ই হচ্ছে। জবাবদিহি না থাকলে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়, বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকে।
সরকারের অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে ফাহিদা খাতুন বলেন, খাদ্য ভর্তুকি এবং ওএমএসে খাদ্য বিক্রি অনেক কমে গেছে। অর্থাৎ গরিব মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়েছে।
এখন যে ধারায় বাজেট করা হচ্ছে, তা দিয়ে বড় পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সরকারের অগ্রাধিকার ঠিক নেই। এই পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তন আনতে হলে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাঁর অভিযোগ, বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ বাড়লেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমছে। এতে জনমিতিসংক্রান্ত সুবিধা কাজে লাগানো সম্ভব হবে না।
অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের গবেষক, শিক্ষক ও সাংবাদিকেরা অংশ নেন।