বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির ৩০ বছরের পথচলা নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিরা। আজ ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির ৩০ বছরের পথচলা নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিরা। আজ ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে

সিপিডির ৩০ বছর পূর্তি

কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এগোনো যাবে না

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যত কমিশন গঠন করেছে, সবগুলোই বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য। কিন্তু কাঠামোগত সংস্থার ছাড়া স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। সে জন্য কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। তবে সেটি হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সুশাসন মাথায় রেখে এসব সংস্কার করতে হবে। তার জন্য নাগরিক সমাজকে সম্মিলিত ভূমিকা পালন করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ রোববার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে আয়োজিত এক আলোচনা সভার সমাপনী অধিবেশনে রেহমান সোবহান এ কথাগুলো বলেন। তিনি এই সংস্থার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় ‘সিপিডির অগ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক সমাপনী পর্বে মূলত আলোচকেরা সংস্থাটির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) থেকে অবসর নেওয়ার পর আমাদের আড্ডাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়ে সিপিডির যাত্রা শুরু হয়। ইস্কাটন গার্ডেন থেকে সিপিডির যাত্রা শুরু। নাগরিক সমাজের কথা বলার জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে চেয়েছিলাম, সেই চেষ্টা থেকেই সিপিডির জন্ম।

‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে মতপ্রকাশের পাশাপাশি গবেষক ও সমাজচিন্তকদের মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রেও একধরনের স্বেচ্ছা সেন্সরশিপ তৈরি হয়েছিল। আগে আমি একটি আর্টিকেল ৩–৪ ঘণ্টায় লিখে ফেলতে পারতাম। কিন্তু গত ১০ বছরে এমনও হয়েছে একটি লেখা লিখতে আমি ১০ দিন সময়ও নিয়েছি। এ ধরনের সেন্সরশিপ স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা।’

সমাপনী অধিবেশনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘এখন সময় এসেছে রাজনীতির সঙ্গে নীতি সমন্বয়ের। এরশাদ সরকারের পতনের পরও রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি শনাক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো পরে আর ঠিক করা যায়নি। এভাবে নানা সময়ে আমাদের বিজয় অর্জিত হয়েছিল, কিন্তু পরে তা আর ধরে রাখা যায়নি। তাই এখন আবার সুযোগ এসেছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে রূপ বা পথ রচনার।’ নিজের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি জণগণের উদ্দেশে বলেন, ‘জমি বর্গা দেওয়া যায় কিন্তু স্বার্থ কখনো বর্গা দিয়েন না। কারও কাছে নিজের স্বার্থ বর্গা দিলে ঠকবেন।’

গণ সাহায্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এফ আর মাহমুদ হাসান বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আদর্শিক যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলায় সিপিডির মতো সংস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, নাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতে সিপিডি দিকনির্দেশনা দিক।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত ৩০ বছরে দেশে বাক্‌স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম ও দেশপ্রেমকে অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি এ কারণে ঘটেছে, সমালোচকেরা যে শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র সেটি বুঝতে অপারগ ছিলেন। এ জন্য সমালোচকেরা সব সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্রের কাছে শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।

বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন বা নীতি–সহায়তার কথা বলার ক্ষেত্রে সিপিডি পাইওনিয়র। তাদের গবেষণাগুলোও অত্যন্ত উন্নত মানের, বাস্তবভিত্তিক ও পেশাদারির ভিত্তিতে করা। এ কারণে, সিপিডির সমালোচনাকে অনেকে ভালোভাবে নিতে পারতেন না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিপিডিকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করত।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সিপিডির স্বপ্নদ্রষ্টা রেহমান সোবহান। অতীতের মতো আগামীতেও সিপিডি একটি ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন, অংশীদারিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সিপিডির গবেষণা আমাকে সহায়তা করেছে।’

সমাপনী আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক ও সমাজব্যবস্থা এক জটিল পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। যেটাকে আমরা ক্রসরোড বা ক্রান্তিকাল বলি। এ অবস্থা থেকে দেশ কীভাবে এগোবে, তার পথরেখা তৈরির জন্য আলোচনা দরকার। সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটা পথরেখা বা অবস্থান তৈরি করতে হবে। এ ধরনের আলোচনার নেতৃত্ব দিতে পারে সিপিডি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা সিপিডির কাছে সেই ভূমিকা প্রত্যাশা করি।’

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ভাইস চ্যান্সেলর রুবানা হক বলেন, সিপিডির সঙ্গে বেসরকারি খাতের সম্পর্ক ব্যর্থ প্রেমের মতো। সংস্থাটিকে বেসরকারি খাতের লোকেরা ভয় পায়। তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ী ও বেসরকারি খাতের কাছে রেফারেন্স পয়েন্ট সিপিডি। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাত খাবি খাচ্ছে। এ অবস্থায় সবাই মিলে এগিয়ে না এলে দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘সরকারের উন্নয়ন বয়ানের বিপরীতে সিপিডি সব সময় বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক বিকল্প মত প্রকাশ করেছে। তার জন্য সংস্থাটিকে বিভিন্ন সময় খেসারতও দিতে হয়েছে। সিপিডি অতীতে যে সাহস দেখিয়েছে ও আমাদের সাহসী হতে সহায়তা করেছে, ভবিষ্যতেও সংস্থাটি সেই পথে থাকবে বলে আমরা আশা করি।’

গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সিপিডি বাংলাদেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যাদের রেফারেন্স আমরা রাজনৈতিক আন্দোলন ও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক বিষয় সামনে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক নির্ধারিত হবে নাকি বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ সম্পর্কের নতুন লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণে সিপিডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’

সঞ্চালকের বক্তব্যে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গবেষণা যদি সমাজ পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখতে না পারে, তাহলে সেই গবেষণা মূল্যহীন। তাই গবেষণা যাতে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে, সেই চেষ্টা করে গেছে সিপিডি।

সমাপনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের সুশাসনবিষয়ক বৈশ্বিক চর্চার পরামর্শক শাহনাজ করিম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান, গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ রাজ্জাক প্রমুখ।