১২ মাসে যেসব শর্ত মানতে হবে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
ছবি: রয়টার্স

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অনুমোদন করা ঋণ পেতে বাংলাদেশকে মোটা দাগে পাঁচ ধরনের সংস্কারকাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে সব মিলিয়ে আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলারের অর্থ সাহায্য দেবে আগামী ৪২ মাসে। এ ঋণ পেতে এ সময়ে অর্থনীতির নানা খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

যেসব সংস্কারের ব্যাপারে আইএমএফ ও বাংলাদেশ একমত হয়েছে, সেগুলো হলো রাজস্ব সংস্কার, মুদ্রা ও বিনিময় হারের সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সংস্কার এবং সামষ্টিক কাঠামো সংস্কার। আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত এসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিছু কাজ করতে হবে অনেকটা জরুরি ভিত্তিতে, আগামী এক বছরের মধ্যে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে, সেগুলো হলো এমন কর রাজস্বব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর আদায় হয়। আইএমএফ মনে করে, পৃথিবীর যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তার একটি। কর আদায় কম হওয়ায় প্রয়োজনীয় খাতে যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করা যায় না। তাই আগামী জুনের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আইএমএফ। আগামী বাজেটেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। আইএমএফ বলছে, বাড়তি অর্থ পাওয়া গেলে অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোতে বাংলাদেশ আরও বেশি খরচ করতে পারবে।

এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক এবং ভ্যাট বিভাগে কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। আর এটি করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। মূলত রাজস্ব আদায় বাড়াতে এ পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। দেশজ উৎস থেকে যে পরিমাণ অর্থ বাজেটঘাটতি পূরণে ব্যবহার হয়, অর্থাৎ সরকার যত ঋণ করে, তার এক-চতুর্থাংশের কম নিতে হবে সঞ্চয়পত্র থেকে। সে লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকার প্রতিবছর বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখে। আইএমএফ চায়, সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ খাতে খরচ কমিয়ে অগ্রাধিকার খাতে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করুক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।

আইএমএফ আরও শর্ত দিয়েছে, পেট্রোলিয়াম–জাতীয় পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয়ের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার। ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজটি করতে হবে। এ প্রস্তাব করা হয়েছে মূলত জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে। এ পরামর্শের কারণও অভিন্ন—অগ্রাধিকারমূলক খাতের জন্য ব্যয় বাড়ানো।

ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্ট বা সরকারি কোষাগারের অর্থ জমার একক ব্যাংক চালুর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি নীতি প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে এই কাজটি করতে হবে। সরকারের নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং রাজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে এ পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।

এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে একটি সুদহার করিডর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুদহার করিডর এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারে পরিচালনভিত্তিক পরিবর্তন করা যায়। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সংজ্ঞা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের হিসাব করতে হবে। মূলত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এ কাজটি করতে হবে জুনের মধ্যে। আইএমএফ মনে করে, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও রিপোর্টিংয়ের মান বাড়বে। পাশাপাশি একই সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফের শর্ত মেনে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি অর্থবছরে একবার জিডিপির হিসাব প্রকাশ করা হয়। দাতা সংস্থাগুলোর অনেক দিনের পরামর্শ জিডিপির হিসাব আরও নিয়মিত ভিত্তিতে প্রকাশ করা। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি এবং নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ড আরও শক্তিশালী হবে বলে আইএমএফ মনে করে।

এ ছাড়া ঝুঁকিভিত্তিক তদারকির কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প আগামী জুনে শেষ করতে বলা হয়েছে। এর লক্ষ্য ঝুঁকিভিত্তিক ব্যাংকিং তদারকি ব্যবস্থা চালু করা। আর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ এবং আর্থিক কোম্পানি আইন ২০২০ জাতীয় সংসদে পেশ করতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর খারাপ সম্পদের তথ্য প্রকাশের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এ তথ্য প্রকাশ করা হলে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। আর এ কাজটি করতে হবে জুনের মধ্যে।

বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণের ১৪০ কোটি ডলার পেয়েছে রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায়। চলতি বছরে বাংলাদেশকে এই ঋণের জন্যও কিছু শর্ত পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব শর্ত ১২ মাসের মধ্যে মানতে হবে, তার মধ্যে রয়েছে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরকারি কেনাকাটা-সংক্রান্ত একটি নীতি দলিল ও সহযোগী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এ শর্ত দেওয়া হয়েছে মূলত সরকারের কেনাকাটা যেন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস করতে ও পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে সে জন্য।

দ্বিতীয় শর্তটি হলো পেট্রোলিয়াম–জাতীয় পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয় করার ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকারি অর্থ খরচের দক্ষতা বাড়াতে এক্সটেন্ডেট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায় এ শর্ত দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি করতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে।

এ ক্ষেত্রে আইএমএফের দেওয়া তৃতীয় শর্তটি পালন করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছে। এ নীতিমালার আওতায়সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জলবায়ুজনিত ঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজটি করতে হবে।