জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো–নামানোর জন্য ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে উঠেছিল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। দুই বছরের মাথায় টার্মিনালটির যন্ত্রপাতি খাতে বিনিয়োগ করে পরিচালনার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের দরপত্রও ডাকা হয়েছিল; কিন্তু তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নূরে আলম চৌধুরীর হস্তক্ষেপে সে দরপত্র বাতিল করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাতে বিদেশি বিনিয়োগ হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশি প্রতিষ্ঠানকে যন্ত্রপাতি কিনে এনসিটি পরিচালনার ভার দেয়।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে পাঁচ জেটির এই টার্মিনাল নির্মাণে বন্দরের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪৬৯ কোটি টাকা। তবে বারবার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের হস্তক্ষেপে টার্মিনালটি আট বছরেও পুরোপুরি চালু করা যায়নি। আর টার্মিনালের সব যন্ত্রপাতি কিনতে বন্দরের তো সময় লেগে যায় প্রায় ১৫ বছর। সর্বশেষ যন্ত্রপাতি কেনা হয় ২০২৩ সালে। সব মিলিয়ে এই টার্মিনালে জেটি ও যন্ত্রপাতি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। বিদেশিদের হাতে দিলে এই অর্থ বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে আসত দেশে।
তবে টার্মিনালে দেশি বিনিয়োগের পর নতুন করে বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ২০২৩ সালের মার্চে আওয়ামী লীগ সরকার এই প্রক্রিয়া শুরু করে, যা এখন অন্তর্বর্তী সরকারও এগিয়ে নিতে চাইছে। এর বিপক্ষে অবশ্য একটি পক্ষ সরব হয়ে উঠেছে। তারা উদ্যোগটির প্রতিবাদে কয়েক দফা বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) সবচেয়ে বড়। এতে সমুদ্রগামী চারটি কনটেইনার জাহাজ একসঙ্গে ভেড়ানো যায়। স্বয়ংক্রিয় ক্রেন থাকায় জাহাজ থেকে আমদানি–রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ওঠানো–নামানো যায় দ্রুতগতিতে। বর্তমানে টার্মিনালটি দেশি অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক পরিচালনা করছে।
পক্ষে–বিপক্ষে যত যুক্তি
টার্মিনালটি বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়ার বিপক্ষে বেশি সরব বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম। এ নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের বিপক্ষে নই। তবে এই টার্মিনালে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। তাহলে কেন বিদেশি বিনিয়োগ ও পরিচালনার জন্য দেওয়া হবে? যেখানে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে, সেখানে বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, ‘বার্থ অপারেটররা ভালোভাবে নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনা করতে সক্ষম। কারণ, সেখানে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করার সুবিধা আছে, যেটি আমরা এখন সনাতন পদ্ধতিতে অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে করছি। বার্থ অপারেটররা যদি পরিচালনার সুযোগ পায়, তাহলে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।’
সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, শুধু টার্মিনালের আয়–ব্যয় দেখলে হবে না; সামগ্রিকভাবে দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই বিষয়টি দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ, দেশটিতে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির মতো বিষয়গুলোও সামনে আসছে। প্রবাসী আয়ের উৎস হিসেবে দেশটি এখন শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে। গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সে দেশ থেকে ৪৬৪ কোটি মার্কিন ডলারের সমান রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় এসেছিল। আবার বন্দর পরিচালনায় ইউএইর ডিপি ওয়ার্ল্ড নামের প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বিশ্বমানের দক্ষতা। নিউমুরিং টার্মিনালে বিনিয়োগ হলেও সেখানে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং যন্ত্রপাতি খাতেও বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি।
বন্দর যেহেতু কৌশলগত স্থাপনা, সে জন্য বিদ্যমান নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি বিনিয়োগ ও পরিচালনার জন্য ছেড়ে দেওয়ার আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দরকার আছে। অংশীজনদের সঙ্গেও আলোচনা করা প্রয়োজন।মো. জাফর আলম, সাবেক সদস্য, পরিচালনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বন্দর
অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি বন্দর পরিদর্শনে এসে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, তা স্বচ্ছ হবে। রাতারাতি কিছু হবে না।
এখন বছরে আয় ৫৭৪ কোটি টাকা
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরা সব বিনিয়োগের পর এখন দেশি অপারেটর দিয়ে নিউমুরিং টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা করছে। গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে এই টার্মিনাল থেকে প্রকৃত আয় হয়েছে ৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার বা প্রায় ৫৭৪ কোটি টাকা।
ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলে সেখানে নতুন করে বিনিয়োগ হবে। টার্মিনালটির পুরো কার্যক্রম তাদের হাতে চলে যাবে। কনটেইনার ব্যবস্থাপনা বাবদ মাশুলও আদায় করবে তারা। বিনিময়ে বন্দরকে কনটেইনার প্রতি নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ দেবে। বিশ্বে এখন বন্দর পরিচালনায় এই মডেল খুব জনপ্রিয়। এতে বন্দরের দক্ষতা বাড়ে বলে মনে করা হয়।
দেশে গত বছর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল একই মডেলে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া হয়। সেখানে অবশ্য যন্ত্রপাতি খাতে বিনিয়োগ করেছে দেশি প্রতিষ্ঠান। বন্দর শুধু জেটি নির্মাণ করে দিয়েছে। এর বিনিময়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি কনটেইনারপ্রতি ১৮ ডলার করে দিচ্ছে বন্দরকে। আশা করা হচ্ছে, নিউমুরিং টার্মিনালে কনটেইনারপ্রতি আয় আরও বেশি হবে। তবে আয় কত হবে, তা নির্ভর করবে দর–কষাকষির ওপর।
সামনে কী
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর বোর্ডের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন করে বন্দর বা টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশি বিনিয়োগ হলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে দ্রুত দক্ষতা বাড়াতে বিদ্যমান টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি বিনিয়োগ বিবেচনা করা যায়। বন্দর যেহেতু কৌশলগত স্থাপনা, সে জন্য বিদ্যমান নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি বিনিয়োগ ও পরিচালনার জন্য ছেড়ে দেওয়ার আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দরকার আছে। অংশীজনদের সঙ্গেও আলোচনা করা প্রয়োজন।
মো. জাফর আলম বলেন, ‘দুই দশক আগে যদি আমরা নিউমুরিং টার্মিনালে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ দিতাম, তাহলে বন্দর উন্নয়ন নিয়ে এখন এত কিছু ভাবতে হতো না। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশই বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে বন্দর খাতে এগিয়ে গেছে।’