বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আইএমইডি

কাজ শেষের আগেই বিল পরিশোধ 

সোনাগাজী ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে চার বছরে ৭০ শতাংশের বেশি টাকা খরচ; ভৌত অগ্রগতি মাত্র ২৯ শতাংশ।

বিদ্যুৎ খাত
বিদ্যুৎ খাত

চার বছর আগে ফেনীর সোনাগাজীতে ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প নেয় ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি)। প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ৭৫৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গত জুনে শেষ হওয়ার কথা।

প্রকল্প তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, চার বছরে প্রকল্পটির ৭০ শতাংশের বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু ভৌত অগ্রগতি মাত্র ২৯ শতাংশ। ৫৩০ কোটি টাকা খরচ হলেও বাস্তব অগ্রগতি তিন ভাগের এক ভাগও নয়। আইএমইডি বলছে, ‘আর্থিক অগ্রগতির তুলনায় বাস্তব অগ্রগতি খুবই কম। তাই কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।’

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আইএমইডির এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। ইতিমধ্যে প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

ইজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রকল্পটি শুরু হলেও ২০২১ সালের জুনে চীনের চ্যাংঝও ট্রিনা ইন্টেলিজেন্স এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং ঝেজিয়াং হুয়াইউন ইলেকট্রিক পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন অ্যান্ড কনসালটেশন কোম্পানির যৌথ ভেঞ্চার ট্রিনা-এইচওয়াইডিসি জেভি-কে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই বছরে এই চীনা ঠিকাদারকে বিপুল পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের কথা আমরা শুনি। এবার আইএমইডির প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। যেমন অনিয়ম করে ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়েছে। কাজে অগ্রগতি না হলে কীভাবে টাকা দেওয়া হলো?
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

আইএমইডির প্রতিবেদন সম্পর্কে এই প্রকল্পের পরিচালক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদন এখনো হাতে পাইনি। তবে ওই প্রতিবেদনের তথ্য সত্য নয়। কোথাও ভুলভ্রান্তি হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কমিশনিং (চালু) হচ্ছে।’

শুধু সোনাগাজী ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নয়; আরও কয়েকটি প্রকল্পে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এসপিসিএল, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএ) এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (শ্রেডা) বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির এমন অন্তত ১০টি প্রকল্প আছে, যেখানে টাকা খরচের তুলনায় বাস্তব অগ্রগতি কম হয়েছে।

আইএমইডির এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই ধরনের প্রকল্পের তালিকায় আছে বড়পুকুরিয়া-বগুড়া, কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন প্রকল্প, ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় ৮ লাখ ৫০ হাজার স্মার্ট প্রি–পেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রকল্প, ওয়েস্ট জোন এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও আপগ্রেডেশন প্রকল্প; জ্বালানি দক্ষতা ও সংরক্ষণ বৃদ্ধি কার্যক্রমে অর্থায়ন প্রকল্প; নবায়নযোগ্য জ্বালানির রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট ও পাইলটিংবিষয়ক কারিগরি সহায়তা প্রকল্প। এসব প্রকল্পের অবস্থা ‘তথৈবচ’ বলে মন্তব্য করেছে আইএমইডি।

বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন দপ্তরের অধীনে ৬৭টি প্রকল্প আছে। এগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএমইডি। আইএমইডির উপসচিব মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান প্রতিবেদনটি তৈরি করেন।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের কথা আমরা শুনি। এবার আইএমইডির প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। যেমন অনিয়ম করে ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়েছে। কাজে অগ্রগতি না হলে কীভাবে টাকা দেওয়া হলো? বিদ্যুৎ খাত ছাড়াও অন্য খাতেও চীনা ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়মের কথা শোনা যায়। এই ধরনের অনিয়ম বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। কারণ, অর্থনীতি বিদ্যুৎ খাতের ওপর বেশ নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ খাত অর্থনীতিতে এখন চাপ সৃষ্টি করছে।’ তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা আছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার কি হচ্ছে? এই খাতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা আনতে হবে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। প্রথম বছরে কোনো প্রকল্পের কোনো কাজ হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রকল্পগুলো নানা সমস্যার কারণে সঠিক সময়ে শেষ হয় না। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ না হওয়ায় ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি জনগণ যথাযথ সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ১২টি প্রকল্প সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২টি প্রকল্পের মধ্যে ৭টি প্রকল্পের মেয়াদ ৭ থেকে ৯ বছর হয়ে গেছে। এসব প্রকল্পের গড় অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ। আবার এই দপ্তরের অধীনে প্রিপেইড মিটারিং ফর ডিস্ট্রিবিউশন কুমিল্লা অ্যান্ড ময়মনসিংহ জোনস প্রকল্পের বয়স ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। ১০ বছরে অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে ডিপিডিসির প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ফর সিক্স এনওসিএস ডিভিশন প্রকল্পের মেয়াদ ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও অগ্রগতি ২২ শতাংশ। এই দুটি প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে আইএমইডির মন্তব্য ‘গ্রহণযোগ্য নয়’। বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পগুলো নিয়ে আইএমইডি বলেছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। এই খাতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে প্রায় ১৭ শতাংশ বা ৪৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।