বক্তারা বলেন, বাজেট কতটা বাস্তবায়িত হলো আর কতটা হলো না, শুধু তা নয়, বরং বাজেটের গুণগত দিক নিয়েও আলোচনা করতে হবে।
স্বচ্ছতা সূচকে বাংলাদেশের বাজেট পেয়েছে ১০০-এর মধ্যে ৩০।
জনসম্পৃক্ততার দিক থেকে১০০-এর মধ্যে পেয়েছে মাত্র ১৩।
সরকার প্রতিবছর যে বাজেট দেয়, তার অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। সে জন্য বাজেটে কী করা হচ্ছে, সে-বিষয়ক প্রচারণা থাকা উচিত। এতে সরকারেরই লাভ, কারণ ভালো কাজ করাই সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়, মানুষ যেন বুঝতে পারে সেটা ভালো কাজ, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সাধারণত প্রতিবছর বাজেটের আগে ও পরে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, কিন্তু বছরের বাকি সময় এ নিয়ে তেমন আলাপ-আলোচনা হয় না। এ বাস্তবতায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিড ও ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপের যৌথ উদ্যোগে গতকাল ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে ওপেন বাজেট সার্ভের ফলাফল নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাজেটের স্বচ্ছতা সূচকে বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে পিছিয়ে পড়েছে।
আজ থেকে তিন দশক আগে ‘সহজ বাজেট’ শীর্ষক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন বলে অনুষ্ঠানে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। বলেন, শুধু ভালো কাজ করলেই হবে না, মানুষ যেন বুঝতে পারে তা ভালো কাজ, সে জন্য বাজেট সম্পর্কে মানুষকে জানানোর কার্যক্রম থাকা উচিত।
আতিউর রহমানের মত, প্রতিবছর বাজেট নিয়ে দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেসব মতামত বা পরামর্শ দেয়, প্রকৃত বাজেটে তার কতটা প্রতিফলন হচ্ছে, বাজেট বক্তৃতায় তার একটা সার সংক্ষেপ থাকতে পারে। এ ছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোকে বাজেট প্রস্তুতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বাজেটবিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি। বলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের জনসংযোগ উপকরণ তৈরি করেছে, যেমন লিফলেট, ফ্লায়ার ইত্যাদি। মন্ত্রণালয়ে যাঁরা বিভিন্ন কাজে আসেন, তাঁদের এসব দেওয়া হয়। তবে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই ভয় পায়; ভাবে, সরকারি কাগজ হাতে নিয়ে কী না কী বিপদে পড়তে হয়।
অনুষ্ঠান উপস্থাপনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আবু ইউসুফ। তিনি বলেন, সরকারের বাজেটপ্রক্রিয়া জনসম্পৃক্ততার দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে। ওপেক বাজেট ইনডেক্স অনুসারে, জনসম্পৃক্ততার দিক থেকে বাংলাদেশের বাজেট ১০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে মাত্র ১৩, অর্থাৎ দেশে বাজেট প্রণয়নে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা খুবই কম। স্বচ্ছতা সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছে ১০০-এর মধ্যে ৩০, যেখানে বৈশ্বিক গড় মান হচ্ছে ৪৫ বাজেট ওভারসাইট বা বাজেট পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ পেয়েছে ১০০-এর মধ্যে ৩৯, যেখানে বৈশ্বিক গড় মান ৫২।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, স্বচ্ছতা সূচকে গত এক দশকে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে বাংলাদেশের মান ছিল ৪৮, ২০২১ সালে তা নেমে এসেছে ৩০-এ। এর মধ্যে ২০১২ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মান ছিল ৫৮।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন র্যাপিডের চেয়ারম্যান ও পিআরআইয়ের পরিচালক এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাজেট বা সামগ্রিকভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু মাথাপিছু বাজেট বরাদ্দে আমরা অনেক পিছিয়ে, দেশের বাজেটের আকার জিডিপির ১৩ শতাংশ।
অথচ এই হার ২০ শতাংশের ঘরে থাকা উচিত বলে মত দেন তিনি, কারণ আমরা ইতিমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি; নিকট ভবিষ্যতে এলডিসি উত্তরণ হবে, তখন মানবসম্পদ উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
বাজেটের মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ করতে হয় বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়েমা হক। এর মধ্য দিয়ে বাজেটের দুর্বলতা খুঁজে বের করা সম্ভব। এ ছাড়া পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কতটুকু বাস্তবায়িত হলো, তা যেন বাজেটের পরিশিষ্টে থাকে। তিনি মনে করেন, এতে সরকারের বৃহৎ পরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়িত হলো, তা বোঝা যাবে। এ ছাড়া বাজেট প্রণয়নে নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা উচিত বলে মত দেন সায়েমা হক।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাজেট কতটা বাস্তবায়িত হলো আর কতটা হলো না, শুধু তা নয়, বরং বাজেটের গুণগত দিক নিয়েও আলোচনা করতে হবে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এর বিকল্প নেই।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন অর্থনৈতিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম।