ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্র, শিল্পের কাঁচামালসহ সব ধরনের পণ্যের ঋণপত্র খোলা কমেছে। আর ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ভোগ্যপণ্য ও মূলধনি যন্ত্রের।
ডলার-সংকট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার ২০ শতাংশের বেশি কমেছে। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ঋণপত্র খোলা কমেছে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।
ফলে ডলারের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো কমেনি। কারণ, আগে খোলা ঋণপত্র ও যেসব আমদানি দায় পরিশোধ বাকি রয়েছে, তা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে নানা উদ্যোগের পর এখনো আমদানি খরচ কমেনি, বরং গত জুলাই-নভেম্বর সময়ে আমদানি খরচ বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার নতুন নিয়মে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ঋণপত্রসংক্রান্ত তথ্যে দেখা গেছে, ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্র, শিল্পের কাঁচামালসহ সব ধরনের পণ্যের ঋণপত্র খোলা কমেছে। আর ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ভোগ্যপণ্য ও মূলধনি যন্ত্রের। তবে শিল্পের কাঁচামালের ঋণপত্র নিষ্পত্তি ছয় মাসে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিক অক্টোবর-ডিসেম্বরে অপরিশোধিত চিনি আমদানির ঋণপত্র খোলা আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। অন্য পণ্যগুলোর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলে ৪৭ শতাংশ, সয়াবিন বীজে ৮৩ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম তেলে ৯৯ শতাংশ, ছোলায় ৪৭ শতাংশ ও খেজুরে ৩০ শতাংশ কমেছে।
আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, দেশে পণ্য আমদানি কম। এতে বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে বাজারে কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে সেই প্রভাব দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে বাজারে চিনির সংকট চলছে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের সঙ্গে সভা করে রমজানের পণ্য আনার ঋণপত্র খুলতে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। ফলে আমদানি খরচও বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এদিকে গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি।
গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ২৫২ কোটি ডলার, এক বছর আগে যা ছিল ৪ হাজার ৪৯২ কোটি ডলার। আর ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা।
গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে।
মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদ কম হওয়ায় ও কয়েকটি ইসলামি ধারার ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা আলোচনায় আসার পর গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদের সীমাও তুলছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আবার অনিয়মের ঘটনায় যথাযথ পদক্ষেপও নিতে পারছে না।
ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল শেষ হয়ে আসছে। গত বছরের নভেম্বরেই ব্যাংক খাতের আমানত প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা কমেছে।
এসবের প্রভাবে এখন এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ১০ শতাংশ সুদেও টাকা ধার করছে। এক দিনের জন্য কলমানি মার্কেটেও (অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করা) সুদহার বাড়ছে। বেড়েছে ট্রেজারি বিলের হারও। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে আমানতের সুদ বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো। কারণ, ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব কারণে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না কিছু ব্যাংক। ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের পাশাপাশি গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক চাহিদামতো সিআরআর রাখতে পারেনি।