দাম কমলেও মূল্যস্ফীতির শঙ্কা কাটেনি বিশ্বে

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছয় মাস পেরিয়ে সাত মাসে পড়েছে। এই যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বেই মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে।

করোনার প্রকোপ থেকে বিশ্ব যখন কেবলই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসা তো দূরের কথা, উল্টো পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। অনিশ্চয়তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা যাচ্ছে জ্বালানির দামে। অপরিশোধিত তেলের দাম গত বছরের শেষ ভাগ থেকেই বাড়তে শুরু করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, যদিও এখন তা ১০০ ডলারের নিচে রয়েছে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর প্রভাব সবকিছুতেই অনুভূত হচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, বেকারের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকাসহ অনেক পশ্চিমা দেশের আর্থিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা বৈশ্বিক জিডিপি বা মোট উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। ক্রমবর্ধমান এই অনিশ্চয়তার আবহে বিশ্বকে প্রধানত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে—১. ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা, ২. মূল্যস্ফীতি ও ৩. আর্থিক খাতে অস্থিরতা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনা মহামারির চেয়েও বড় ঘাতক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। তবে কেবল যুদ্ধের কারণেই যে এই মূল্যস্ফীতি, তা–ও ঠিক নয়। গত দুই বছরে বিভিন্ন দেশের রাজস্ব ও মুদ্রানীতি যে পথে হেঁটেছে, এটা তারও ফল বটে। সেগুলোই এখন অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম থেকে কোভিডের অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি একরকম উধাও হয়ে গেছে। গত বছর এ সময় আলোচনা হতো—কোন দেশের কত মানুষ টিকা পেয়েছে এবং তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কোন পথে চলছে। টিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্পর্ক নিয়ে নানান আলোচনা হতো। কিন্তু এখন সেসব আলোচনা নেই বললেই চলে। আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হচ্ছে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব শুধু বাংলাদেশে নয়, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশেও পড়েছে। বলা যায়, মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় ব্রিটেনের জনগণের দিশাহারা হওয়ার জোগাড় হয়েছে। গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত নিবন্ধে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন দেখিয়েছেন, এক লাফে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে কীভাবে সেই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘জ্বালানি-দারিদ্র্য’। দেখিয়েছেন, কীভাবে এ কারণে হীনম্মন্যতায় ভোগা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। অনেক মা-বাবা টাকার অভাবে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। এসব শিশু অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে সংকোচ বোধ করছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এতে ১ কোটি পরিবারের ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ জ্বালানি-দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়েছে।

এখানেই শেষ নয়, আসন্ন শীত মৌসুমে দেশটিতে গড় জ্বালানি ব্যয় বার্ষিক হিসাবে ৩ হাজার ৬০০ পাউন্ড দাঁড়াতে পারে। ফলে অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশ এবং আগামী বছর জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ১৯ শতাংশে উঠতে পারে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এতে সেখানকার ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ জ্বালানি-দারিদ্র্যে পড়বে। গর্ডন ব্রাউন মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যর্থ হওয়া রাজনীতিকদের সমালোচনা করে বলছেন, ক্ষমতার কেন্দ্রে যাঁরা থাকেন, মানুষের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠুরতা শুধু অযোগ্যতা ও অসংবেদনশীলতা নয়, অনৈতিকও বটে।

রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে ইউরোপ। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বেশির ভাগ দেশ জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এদিকে শীত আসন্ন, অক্টোবর থেকে ইউরোপে হানা দিতে পারে শীতের ছোবল। বিকল্প জ্বালানির সংস্থান না হলে ইইউকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বুঝতে শীত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিছু কিছু দেশ জ্বালানি নিষেধাজ্ঞার স্পষ্ট বিরোধিতা করছে, যেমন হাঙ্গেরি। কারণ, তারা রাশিয়ার তেলের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল।

সব দেশ একই বাজার থেকে তেল কিনলেও সবাই একই কিংবা কাছাকাছি দামে তা বিক্রি করে না। এ ক্ষেত্রে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করা হয়। চীন ও হংকং একই দেশ হওয়া সত্ত্বেও হংকংয়ে তেলের দাম অনেক বেশি। কারণ, হংকংয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা চীনের চেয়ে বেশি। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জ্বালানির দাম নির্ধারণে এ বিষয় মাথায় রাখা দরকার।

খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের মোট গম উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়। আর ভুট্টার ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় এই দুই দেশে। যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে এই দুই দেশ থেকে গম ও ভুট্টাসহ অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের রপ্তানি। এই গ্রীষ্মে গম উৎপাদনই করতে পারেনি ইউক্রেন। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) খাদ্যমূল্য সূচক আকাশ ছুঁয়েছে। ২০২১ সালে বৈশ্বিক গড় খাদ্যমূল্য সূচক যেখানে ছিল ১২৫ দশমিক ৭, চলতি বছর আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৯ দশমিক ৭। অর্থাৎ ৮ মাসে বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সূচক বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।

তবে জাতিসংঘ সংস্থা এফএওর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই মাসে খাদ্যপণ্যের দাম আগের মাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সংস্থাটি খাদ্যপণ্যের দাম ‘খুব উচ্চ পর্যায় থেকে’ পতনকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে বলেছে, এই সুসংবাদ স্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

এফএওর প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টোরেরো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, এখনো অনেক অনিশ্চয়তা আছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সারের উচ্চ দাম। এতে ভবিষ্যতের উৎপাদন সম্ভাবনা ও কৃষকদের জীবিকা প্রভাবিত হতে পারে। সেই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বলতা, মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা—এগুলো বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, ইউক্রেনের শস্য করিডর শেষ হলে খাদ্যের দাম কিন্তু আবার বাড়তে পারে। স্বল্প মেয়াদে অবশ্য দাম আরও কমতে পারে, তবে ভবিষ্যতের কথা বলা যাচ্ছে না। গম, সয়াবিন, চিনি ও ভুট্টা প্রভৃতি খাদ্যপণ্যের দাম কমে এখন ২০২২ সালের শুরুর অবস্থায় ফিরে এসেছে। যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে গত শুক্রবার প্রতি বুশেল (প্রতি বুশেল যুক্তরাজ্যে ৩৬ দশমিক ৪ লিটার আর যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ দশমিক ২ লিটারের সমপরিমাণ) গম ৭৭৫ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলারে বেচাকেনা হয়েছে, যা বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ছিল ৭৫৮ ডলার। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে মার্চে প্রতি বুশেলের দাম বেড়ে ১ হাজার ২৯৪ ডলারে ওঠে।

এফএওর খাদ্য মূল্যসূচক অনুযায়ী জুলাই মাসে প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর দাম গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে বিশেষ করে গমের দাম ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। সংস্থাটির মতে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার শস্য চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় ও পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে এবার ভালো ফসল হওয়ায় গমের দাম বেশি কমেছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।

যুদ্ধের প্রভাবে ইতিমধ্যে বৈশ্বিক সংস্থাগুলো এ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করেছে। কোভিড ও যুদ্ধের ধারাবাহিক ধাক্কায় বিশ্বের উন্নয়নশীলসহ উন্নত দেশের অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, তাদের জীবনমানের অবনতি হচ্ছে।

খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ‘চ্যাম্পিয়নস গ্রুপ অব গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স’ (জিসিআরজি) গঠন করেছেন। এই গ্রুপের মূল্য উদ্দেশ্য যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্বের দরিদ্র ও ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া। জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই গ্রুপে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশও। সূত্র: বিবিসি, ডয়চে ভেলে