রোজার পণ্য আমদানির মানচিত্র বদলে যাচ্ছে

এক বছর আগেও ইফতারে অস্ট্রেলিয়ার ছোলা ছাড়া বিকল্প ছিল না। কারণ, দেশটি থেকেই আমদানি হয়েছিল সব ছোলা। এবার অস্ট্রেলিয়ার ছোলার সঙ্গে ইফতারের টেবিলে উঠতে পারে ভারতের ছোলাও। কারণ, বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার রেকর্ড পরিমাণ ছোলা এসেছে ভারত থেকে। এবার রোজার বাজারে যত ছোলা বেচাকেনা হচ্ছে, তার ৪৪ শতাংশই এসেছে দেশটি থেকে। বাংলাদেশে ছোলা আমদানির মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ভারত।

ভারত বিশ্বের শীর্ষ ছোলা উৎপাদনকারী দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, ২০২১ সালে দেশটি ১ কোটি ১৯ লাখ টন ছোলা উৎপাদন করেছে। তবে দেশটিতে চাহিদা বেশি থাকায় সাধারণত ছোলা রপ্তানি হয় কম। কিছু পরিমাণ কাবলি ছোলা রপ্তানি করে তারা। উল্টো দেশের চাহিদা মেটাতে আমদানি করতে হয় তাদের। কিন্তু এবার ফলন ভালো হওয়ায় দেশটি সাধারণ ছোলাও রপ্তানি করছে। বেনাপোল, বাংলাবান্ধা, সোনামসজিদ ও হিলি স্থলবন্দর দিয়েই বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৬৯ হাজার টন ছোলা।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়ার পরে বাংলাদেশের ছোলা আমদানির বিকল্প দেশ ছিল পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেনের মতো দেশ। ছোলা আমদানির মানচিত্র থেকে এসব দেশ মুছে গেছে এবার। ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মানচিত্রে ক্ষুদ্র আকারে জায়গা করে নিয়েছে তানজানিয়া, মিয়ানমার ও কানাডা।

ছোলার মতো মটর ডাল, মসুর ডাল, চিনি, সয়াবিন তেলের কাঁচামাল বীজ ও অপরিশোধিত সয়াবিন, পামতেল ও খেজুর আমদানির দেশ হিসেবেও মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন দেশ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে আমদানিতে শীর্ষ তালিকায় এই রদবদল হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাওয়া এবং বৈশ্বিক ফলনের তারতম্যে এবার রোজার পণ্য আমদানির মানচিত্র বদলে গেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক ও ডাল মিল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সঞ্জয় দেব প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে সাধারণত ছোলা আমদানি হয় না। এবারই প্রথম ছোলা আমদানি হয়েছে প্রচুর। ছোলার মতো ডালজাতীয় পণ্যও এসেছে দেশটি থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় উৎপাদন কম আর ভারতে বাম্পার ফলন এ চিত্র বদলে দিয়েছে।

রোজার পণ্য আমদানির হয় মূলত রোজার দুই-তিন মাস আগে থেকে। চলতি বছরের প্রথম আড়াই মাসের আমদানির তথ্যে দেখা যায়, এবার ২৯ দেশ থেকে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন রোজার পণ্য আমদানি হয়েছে। পাঁচ বছর আগে এ তালিকায় ছিল ৩৩টি দেশ। পাঁচ বছর আগেও রোজার পণ্য আমদানির মানচিত্রে শীর্ষ পাঁচে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, কানাডা ও ইউক্রেন। এবার সেরা পাঁচের তালিকা থেকে বের হয়ে গেছে আর্জেন্টিনা ও ইউক্রেন। জায়গা করে নিয়েছে ভারত ও ব্রাজিল। এর মধ্যে ডালজাতীয় পণ্য ও চিনি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত জায়গা করে নিয়েছে শীর্ষ পাঁচে।

পণ্যভিত্তিক আমদানির উৎস দেশের তালিকায় ফেরা যাক। ছোলার মতো গত রোজার আগে মসুর ডালের আমদানির ৯৮ শতাংশ ছিল অস্ট্রেলিয়ার। এবার অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের অংশীদারি উল্লেখ করার মতো। ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১৫ শতাংশ। নেপাল ও কানাডা থেকেও এসেছে মসুর ডাল। ডাল আমদানির তালিকা থেকে এবার বেরিয়ে গেছে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র।

গত বছর রোজায় মটর ডাল আমদানিতে শীর্ষ দেশ ছিল রাশিয়া। দেশটি থেকে আমদানি হয়েছিল ৯৫ শতাংশ মটর ডাল। রাশিয়ার পর দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ ছিল ইউক্রেন। প্রায় ৪ শতাংশ আমদানি হয়েছিল দেশটি থেকে। ১ শতাংশ ছিল অস্ট্রেলিয়ার। এবার বেশ পাল্টেছে এই চিত্র। রাশিয়ার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে কানাডা। ইউক্রেন মুছে গেছে মটর ডাল আমদানির মানচিত্র থেকে। নতুন করে তালিকায় ঢুকেছে ভারত। যেমন কানাডা থেকে আমদানি হয়েছে ৯৫ শতাংশ মটর ডাল। আর ভারত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে মোট আমদানির ২ শতাংশ করে আমদানি হয়েছে। যে রাশিয়া থেকে আমদানি হয়েছিল ৯৫ শতাংশ, এবার তা নেমে এসেছে ১ শতাংশে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেই মূলত মটর ডাল আমদানির মানচিত্রে এ বদল এসেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।  

এবার খেজুর আমদানির তথ্য দেখা যাক। এ বছর রোজার খেজুর আমদানি হয়েছে ২০টি দেশ থেকে। গত বছর আমদানি হয়েছিল ১৭টি দেশ থেকে। পরিমাণে খুব কম হলেও এবার ফ্রান্স, ভারতসহ তিনটি দেশ যুক্ত হয়েছে তালিকায়।

খেজুরের মানচিত্রে খুব বেশি উল্টোপাল্টা হয়নি। শীর্ষ তালিকায় রদবদল হয়েছে একটি দেশের। যেমন গতবার খেজুর আমদানির শীর্ষ পাঁচ দেশ ছিল ইরাক, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, আলজেরিয়া ও পাকিস্তান। এবার পাকিস্তানকে হটিয়ে তিউনিসিয়া শীর্ষ পাঁচে জায়গা করে নিয়েছে।

বিশ্বে মাত্র ৪০টি দেশে খেজুর উৎপাদন হয়। শুধু ইসরায়েল থেকে খেজুর আমদানি হয় না। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশটি থেকে আমদানির সুযোগও নেই। তাই খেজুরসহ পণ্য আমদানির মানচিত্রে নেই দেশটি।

এদিকে কয়েক বছর ধরে রোজায় গমের ব্যবহার বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গম আমদানির মানচিত্র ঘন ঘন বদলেছে। যেমন যুদ্ধের পর দেশ দুটি থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। দুই দেশের ঘাটতি পূরণে জায়গা করে নেয় ভারত। আবার বিধিনিষেধের কারণে ভারত থেকে গত নভেম্বরের মাঝামাঝি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নতুন গন্তব্যের সন্ধানে নামেন এ দেশের আমদানিকারকেরা। এ বছরের প্রথম আড়াই মাসে মাত্র চারটি দেশ থেকেই গম আমদানি হয়েছে। দেশ চারটি হলো রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগরে শস্য চুক্তির কল্যাণেই ইউক্রেন থেকে গম আমদানি সম্ভব হয়েছে। গতবারের মতো এবার গম আমদানির মানচিত্র থেকে বাদ পড়েছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র।

একসময় চিনি মানেই ছিল ব্রাজিল। ব্রাজিল থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে থাকে পরিশোধন কারখানার মালিকেরা। আর পরিশোধিত চিনি আমদানি হতো থাইল্যান্ড থেকে। দু-এক বছর ধরে দেশে ভারতের চিনির অংশীদারি বাড়ছে।

গত রোজার আগে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছিল মূলত দুটি দেশ থেকে। দেশ দুটি হলো ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। এই তালিকায় এবার জায়গা করে নিয়েছে প্যারাগুয়ে। আবার সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবীজ আমদানির মানচিত্র থেকে ব্রাজিল ও কানাডাকে বিদায় করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

পামতেল আমদানির মানচিত্র অনেক আগেই বদলে গেছে। একসময় মালয়েশিয়া থেকে সিংহভাগ পামতেল আমদানি হতো। এখন এই জায়গা পাকাপাকি করেছে ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার অংশীদারি প্রায় ৮৯ শতাংশ। পামতেল আমদানির মানচিত্রে জায়গা ছোট হয়ে আসছে মালয়েশিয়ার।

ব্যবসায়ীরা জানান, তুলনামূলক কম দর ও দ্রুত সময়ে আমদানির নিশ্চয়তা আছে, এমন উৎস থেকেই ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে অগ্রাধিকার দেন। আমদানিকারকদের এমন চাওয়া পূরণ করেন পণ্য সরবরাহকারীরা। আমদানিকারক ও সরবরাহকারীর এমন ইচ্ছায় অনেক সময় গতিপথ বদলে যায় আমদানির উৎসের। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে প্রায়ই বদলে যায় আমদানির মানচিত্রও।