বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা হলো, খেলাপি ঋণ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অক্ষমতা। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে; বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু করতে পারেনি।
‘বিপর্যস্ত ব্যাংকিং খাতে ব্যাংক একীভূতকরণের প্রভাব’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বিশ্লেষক-বক্তারা এই অভিমত দেন। আজ শনিবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন হঠাৎ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত হওয়ার জন্য কেন চাপ দিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। তাঁদের আশঙ্কা ও অভিযোগ, ব্যাংক একীভূতকরণের মধ্য দিয়ে দোষীদের রেহাই দিয়ে জনগণের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হবে। আর নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে যে ক্ষমতাবানেরা পরস্পরের সঙ্গে যোগসাজশ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
মূল প্রবন্ধে উন্নয়ন ও অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক এবং জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প গবেষক জিয়া হাসান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একসময় খেলাপি ঋণ কম করে দেখানোর জন্য নিয়ম পর্যন্ত পরিবর্তন করেছে। এখন আবার তারা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থানকে তিনি লাঠি দেখানো ও মুলা ঝোলানোর নীতি হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, এই মুলাটা জুটতে পারে দুর্নীতিবাজ ও ঋণখেলাপিদের; লাঠিটা সম্ভবত পড়বে সাধারণ করদাতাদের পিঠে। অর্থাৎ এর দায় বর্তাবে দরিদ্র জনগণ বা সাধারণ করদাতাদের ওপর। এর মধ্য দিয়ে ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের দায়মুক্তি দেওয়া হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
নিজ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে জিয়া হাসান বলেন, পদ্মা ব্যাংকের মন্দ ঋণের দায় কে নেবে, সেটাই হলো বড় প্রশ্ন। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এই ঋণের দায় নেবে বলে সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তো এখন পর্যন্ত সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির আইনি কাঠামোই তৈরি করেনি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে গণপরিসরে আলোচনা হওয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক জোর করে এই একীভূতকরণের দিকে এগোলে আদালতে তারা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
ওয়েবিনারটিতে বক্তাদের কথায় বারবার প্রভাবশালীদের পার পেয়ে যাওয়ার বিষয়টা উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দুর্বল ব্যাংকের তালিকা করার ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে যে প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন দুর্বল ব্যাংকগুলো এই তালিকায় স্থান না–ও পেতে পারে। পদ্মা ব্যাংকের অবস্থা সবাই জানেন, কিন্তু এক্সিম ব্যাংকের অবস্থা যে খুব ভালো, তা-ও নয়। এই পরিস্থিতিতে ভাসা ভাসা পদক্ষেপ নেওয়া হলে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হবে না।
এই বাস্তবতায় ফাহমিদা খাতুন আবারও ব্যাংকিং কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, কমিশন গঠন করে সরকারের উচিত হবে, খোলা মন নিয়ে কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করা। এই সরকার টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাধারণত এসব ক্ষেত্রে সরকারের একধরনের কর্তৃত্ব তৈরি হয়; তারা অনেক কিছু করতে পারে।
সিডনি পলিসি অ্যানালাইসিস সেন্টারের আন্তর্জাতিকবিষয়ক পরিচালক জ্যোতি রহমান বলেন, ‘খেলাপি ঋণের বোঝা এক দিনে তৈরি হয়নি। অনেক দিন ধরেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কীভাবে আমরা আজ এই পরিস্থিতিতে উপনীত হলাম, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’
জ্যোতি রহমান মনে করেন, খেলাপি ঋণ সমস্যার টেকনিক্যাল সমাধান পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমাধান। তিনি বলেন, যাঁদের কারণে এই সংকট, তাঁরা পার পেয়ে যান, আর ভুক্তভোগী হন জনগণ।
সঞ্চালক মনির হায়দার বলেন, দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দায় নেয় না। এটা শুধু আর্থিক খাতে নয়, সব খাতেই দেখা যায়। র্যাংগস ও বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে ঠিক, কিন্তু কীভাবে সেগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে দিনের পর দিন ধরে গড়ে উঠেছিল, তার দায় কেউ নেয়নি।
অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী হিসাববিদ মাহমুদ হোসেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মন্দ ঋণ অধিগ্রহণের নিয়মকানুন নিয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি কি আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে বাজারমূল্যে এই সম্পদ কিনবে, নাকি বুক ভ্যালুতে কিনবে। পদ্মা ব্যাংকের যে অবস্থা, তাতে ব্যাংকটির মন্দ ঋণের মূল্য এখন নেতিবাচক হয়ে যাওয়ার কথা।
গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনেক মিল থাকলেও সেই দেশে খেলাপি ঋণ নিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক সদিচ্ছার।