পরিকল্পনামন্ত্রী বা রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের অনুমোদন ছাড়াই পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে চায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। দেশের পরিসংখ্যান আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় সংস্থাটির সামনে অনুমোদন ছাড়াই পরিসংখ্যান প্রকাশের ক্ষমতা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে যেকোনো তথ্য–উপাত্ত বা পরিসংখ্যান প্রকাশের আগে পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শুধু মন্ত্রীর অনুমোদনের বিষয়টিই নয়; সার্বিকভাবে পুরো আইনটিই পর্যালোচনা করা হচ্ছে। মন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া পরিসংখ্যান প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়ে সংশোধনী আনতে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সায় আছে।
বর্তমানে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বিবিএসের ‘একটি চৌকস দল’ ২০১৩ সালের পুরো পরিসংখ্যান আইনটি পর্যালোচনা করছে। আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য শিগগিরই একাধিক কমিটি গঠন করা হবে।
বিবিএসের পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন ছিল। অর্থনীতিবিদেরা অভিযোগ করতেন, সব সরকার রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য নিজেদের মতো পরিসংখ্যান দেখায়। যেমন প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো, প্রকৃত (উচ্চ) মূল্যস্ফীতি লুকানো ইত্যাদি। জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিবিএসের তথ্য–উপাত্ত বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আইন সংশোধন, পদ্ধতি আধুনিকায়ন ও লোকবল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে কারসাজির অভিযোগ সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বিরুদ্ধে। এক দশক আগে বিবিএসের কর্মকর্তারা মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক হিসাব নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৫, মানে আধা শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই তথ্য তিন মাস পরপর প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির তথ্য–উপাত্ত নিয়েই রাজনীতিবিদেরা বেশি মাথা ঘামান। উন্নয়ন ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানোর জন্য জিডিপির হার বাড়াতে বলেন তাঁরা।
পরিসংখ্যান ও তথ্যব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দিপংকর রায় প্রথম আলোকে বলেন, পরিসংখ্যান নিয়ে ইদানীং বেশ কথা হচ্ছে। তথ্য–উপাত্ত বা পরিসংখ্যান যুগোপযোগী করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি গণনায় সংস্কার আনা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের নীতিমালা অনুসারে জিডিপি গণনা করা হয়। জিডিপি গণনায় ৮০ শতাংশ তথ্য–উপাত্ত সরকারের অন্যান্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য–উপাত্ত থেকে নেওয়া হয়।
সব সরকারের সময় পরিসংখ্যান কারসাজির অভিযোগ আছে। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্ত্রীরাই পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে বেশি কারসাজি করেছেন, এমন অভিযোগ অর্থনীতিবিদদের। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, অর্থনীতি নিয়ে সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান কারসাজির বিষয়ে বিশেষ একটি অধ্যায় বা আলোচনা থাকছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে, বিশেষ করে আ হ ম মুস্তফা কামাল পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে বিবিএসের পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে বেশি কারসাজির অভিযোগ ছিল। জানা গেছে, এক দশক আগে বিবিএসের কর্মকর্তারা জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক হিসাব নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে গেলে তিনি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব দেখে তা আরও দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে বলেন।
বিবিএস সাধারণত প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করত। কিন্তু ২০১৭ সালে হঠাৎ মূল্যস্ফীতির তথ্য তিন মাস পরপর প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর কারণ, তখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল। পরে মূল্যস্ফীতি কমে এলে আবার প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের ধারা শুরু করা হয়। অভিযোগ আছে, তিনি মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে দেখানোর নির্দেশ দিতেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষের দিকে তো মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সবুজসংকেত লাগত। একনেক সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে তবেই মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হতো।
বিবিএস হলো পরিসংখ্যান–সংক্রান্ত জাতীয় সংস্থা। অনেক সময় ক্ষমতাসীন মন্ত্রীরাও বিবিএসের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আদমশুমারির তথ্য–উপাত্ত নিয়েও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তখনকার কৃষিমন্ত্রী সদ্য প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী একমত হতে পারেননি। ২০১১ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যান নিয়ে এক অনুষ্ঠানে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হন কৃষিমন্ত্রী। আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হিসাব করা হয়েছিল ১৪ কোটি ৯৭ লাখ। কিন্তু কৃষিমন্ত্রীর দাবি ছিল, এই সংখ্যা ১৬ কোটি। তা না হলে এত কৃষি উৎপাদন বা খাবার যায় কোথায়?
বিএনপি সরকারের আমলেও (২০০১-০৬) এমন ঘটনা ঘটেছিল। তাদের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধেও পরিসংখ্যান কারসাজির অভিযোগ ছিল। একবার সিলেট যাওয়ার সময় সড়কের দুই পাশে বহু শিল্পকারখানা তাঁর নজরে পড়েছিল। এই যুক্তি দেখিয়েই সাইফুর রহমান সে সময় বিবিএসের তৈরি করা জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ মানেননি।