প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সরকারি কর্মচারীরা গাড়ির অপব্যবহার বন্ধ করবেন কি

সরকারি কর্মচারীরা গাড়ির অপব্যবহার করে আসছিলেন বহু বছর ধরেই। এটা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। গাড়ির অপব্যবহারের ধরনও বহুমাত্রিক। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দুই সপ্তাহ আগে (২ সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করতে বলেছে। তার পর থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের আওতাধীন সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। তবে যথাযথ নজরদারি না থাকলে এসব চিঠি আগের মতোই পড়ে থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন।

সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের বেশ কিছু কর্মচারী প্রচলিত বিধি ও প্রাধিকারবহির্ভূতভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থা, ব্যাংক-বিমা, কোম্পানি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি চেয়ে আনছে।

গাড়ি–সুবিধার প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সুপারিশ অনুযায়ী সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে কমপক্ষে তিন বছর পার করেছেন এমন কর্মকর্তা, সরকারের যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিব।

উপসচিব থেকে তার ওপরের পদের সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার জন্য প্রথমবারের মতো সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করে আওয়ামী লীগ সরকার। এ জন্য ২০২০ সালে একটা নীতিমালাও জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। তখন অর্থসচিব ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। নীতিমালার আওতায় গাড়ি কেনার জন্য ঋণ–সুবিধার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চিঠিতে বলা হয়, সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কিনে এবং মাসে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে নিয়েও কোনো কোনো কর্মকর্তা অনৈতিক ও বিধিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহার করছেন, যা নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গাড়ি ব্যবহারে প্রজাতন্ত্রের কিছু কর্মচারীর এ ধরনের প্রবণতার কারণে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। আবার আর্থিক অপচয়ের কারণও ঘটছে।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সব সদস্য এবং আইআরডির আওতাধীন সংস্থা জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরকে গাড়ি ব্যবহারে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা পরিপালন করতে অনুরোধ করেছে।

আইআরডি সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে যাঁরা গাড়ি কিনেছেন, আবার সবার জন্য যে গাড়ি তা–ও ব্যবহার করছেন—মূল অনিয়মের বিষয়টি এখানে। এনবিআরের কর্মকর্তারা এ ধরনের ঋণই পান না, যেহেতু তাঁরা উপসচিব নন। তবে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর পরিবহন পুলে গাড়ি জমা দেওয়ার যে বিধান আছে, মাঝেমধ্যেই তার ব্যত্যয় হয় বলে শোনা যায়। আমার দপ্তরের আওতাধীন কোনো প্রকল্পের গাড়ির ক্ষেত্রে এ ব্যত্যয় হতে দেব না।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতাসহ ছয় ব্যাংক এবং বিশেষায়িত আরও ১০ ব্যাংক রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশন, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি সংস্থা। এসব ব্যাংক ও সংস্থার গাড়ি নিয়মিতভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করার উদাহরণ আছে বলে জানা গেছে।

যোগাযোগ করলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন চর্চা আগে থাকলেও এখন নেই।’

স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে গাড়ি ব্যবহারে বেশি অনিয়ম হচ্ছে বলে সূত্রগুলো জানায়। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতাধীন অনেক প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের গাড়ি তাঁরা পারিবারিক কাজে শুধু নয়, আত্মীয়স্বজনকে ব্যবহার করতে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে আনা-নেওয়ার কাজেও অনেক সরকারি গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

প্রকল্প শেষ হওয়ার পর গাড়িগুলো সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে জমা হওয়ার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা পরিপালিত হয় না। যানবাহন অধিদপ্তর এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকাও রাখতে পারে না, শুধু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখতে পারে।

সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকেই প্রকল্প শেষ হলে গাড়ি জমা দেন না। এ জন্য আমরা বহুবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি।’

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক বছর আগের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও ৪০০ গাড়ি পরিবহন পুলে জমা দেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও রেলপথ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৬৯টি গাড়ির হদিসই নেই। অথচ নিয়ম রয়েছে প্রকল্প শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে গাড়ি পুলে জমা হওয়ার।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এমন উদ্যোগ আগেও নেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ভেস্তে গেছে। ফলে উদ্যোগ বাস্তবায়নের এখনই মোক্ষম সময়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিষয়টি নজরদারি করতে পারে।