হঠাৎ কমে গেছে গরুর মাংসের দাম। দোকানে সারিতে দাঁড়িয়ে অনেকে মাংস কিনছেন। তাতে কমেছে চাষের মাছ ও মুরগির দাম।
ঢাকার বাজারে গরুর মাংসের দাম বেশ কমেছে। প্রতি কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হওয়া গরুর মাংস এখন ৬৫০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ৫৫০ টাকা কেজিতেও গরুর মাংস কেনা যাচ্ছে। ফলে মধ্যবিত্ত ক্রেতা তো বটেই, অনেক নিম্নমধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ দোকানে সারিতে দাঁড়িয়ে গরুর মাংস কিনছেন। দুই সপ্তাহ ধরে গরু মাংসের দামে এই পরিবর্তনের ফলে বাজারে কমতে শুরু করেছে চাষের মাছ ও ব্রয়লার মুরগির দামও।
ঢাকার বিভিন্ন বাজারের সবচেয়ে ব্যস্ত দিন শুক্রবার দামের এই পরিবর্তন দেখা গেছে। একই চিত্র দেখা গেছে গতকাল শনিবারও। সকালে রাজধানীর মগবাজার, মালিবাগ, শাহজাহানপুর ও রামপুরা বাজারের বেশির ভাগ দোকানে গরুর মাংস ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। কিছু দোকানে আরেকটু কমেও গরুর মাংস পাওয়া গেছে। যেসব দোকানে দাম কম দেখা গেছে, সেসব দোকানে ক্রেতার বেশ ভিড়। মানুষ গরুর মাংস আগের তুলনায় বেশি কেনায় চাষের মাছ ও ব্রয়লার মুরগির বেচাকেনা কমেছে। ফলে এই দুই পণ্যের দামও খানিকটা কমেছে।
গতকাল বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের তুলনায় চাষের তেলাপিয়া, পাঙাশ, রুই, কই ও শিংয়ের মতো মাছের দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা কমেছে। মাঝারি ও ছোট আকারের তেলাপিয়া ও পাঙাশ বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। কিছু দোকানে পাঙাশ ১৮০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা গেছে। চাষের কই মাছের দাম পড়ছে প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৩০ টাকা। আর শিংয়ের কেজি নেমে এসেছে ৩৫০ টাকায়। আকারে বড় হলে রাখা হচ্ছে ৪০০ টাকার মতো। কমেছে রুই মাছের দামও, মানভেদে চাষের রুইয়ের কেজি পড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। তবে নদীর ও হাওরের মাছের দামে বড় পার্থক্য দেখা যায়নি।
বিক্রেতারা বলছেন, গরুর মাংস আগের চেয়ে সস্তায় বিক্রি হতে থাকলে মাছের বাজারে আরও প্রভাব পড়বে। মগবাজার বাজারের মাছ বিক্রেতা তানজীব ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাংসের দাম কমে আসায় মাছের বাজারে ক্রেতা কম। তাতে কম দামেই মাছ ছাড়তে হচ্ছে। বেচাকেনা আগের থেকে কমে এসেছে। একই সঙ্গে লাভের অঙ্কও কমেছে।’
অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১০ থেকে ২০ টাকা কমে অধিকাংশ বাজারে ১৭০ টাকায় নেমে এসেছে। আর সোনালি মুরগির দাম কমে হয়েছে প্রতি কেজি ২৮০ টাকা। দরদাম করলে কোনো কোনো দোকানি সোনালি মুরগির আরও কম রাখছেন। ভারত থেকে ডিম আমদানি পর ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম কমতির দিকে ছিল। মুরগির দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে এবার ডিমের দাম আরও কিছুটা কমেছে। এক ডজন বাদামি ডিম পাওয়া যাচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। আর সাদা রঙের ডিম ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। বেশি নিলে সাদা ডিম কেউ কেউ ১১০ টাকাও রাখছেন।
মালিবাগ বাজারের মুরগি বিক্রেতা মো. জামানকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অনেকটা চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেল। বেচাকেনার কী অবস্থা, জানতে চাওয়া হলে ঝটপট উত্তর দিলেন তিনি। বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন। গরুর মাংসের দাম কমার ফলে ক্রেতারা সেখানেই ভিড় করছেন। আমাদের এখন আর কদর নেই। বেচাবিক্রি নেই। তবে নিয়মিত কিছু ক্রেতা আছেন, যাঁরা টুকটাক কিনছেন। রেস্টুরেন্ট ও হোটেলের বেচাকেনার ওপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে।’
গরুর মাংস বিক্রেতারা জানিয়েছেন, রাজধানীর যেসব এলাকায় সীমিত আয়ের মানুষ বেশি থাকেন, সেসব এলাকায় গরুর মাংসের দাম বেশি কমেছে। গত মার্চে গরুর মাংসের দাম বেড়ে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায় উঠেছিল। তাতে গরুর মাংস সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও বিপাকে ছিলেন। এখন বেচাকেনা বেড়েছে কয়েক গুণ।
গরুর মাংসের দাম কমায় ক্রেতারা বেশ খুশি। সঙ্গে মাছ-মাংসের দাম কমতে শুরু করায় চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছেন তাঁরা। রামপুরা বাজারে গৃহিণী নাসরিন বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোরবানির পর আর গরুর মাংস কেনা হয়নি। অনেকে কম দামে মাংস কিনেছেন শুনে আমিও এলাম। বাচ্চাকাচ্চারা অনেক দিন ধরে বলছিল। দাম না কমলে কেনা কষ্ট হতো।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিপূরক পণ্য হওয়ায় গরুর মাংসের দাম কমার প্রভাব অন্য মাছ-মাংসে পড়বে, সেটা স্বাভাবিক। বাজারে এ ধরনের প্রতিযোগিতা থাকা দরকার। তাতে সাধারণ মানুষ পুষ্টিকর খাবার খেতে পারবেন। তবে শীতকালে ডিমের দাম সব সময় একটু কম থাকে।’
রাজধানীর মালিবাগ থেকে রামপুরার দিকে এগোলে রাস্তার বাঁ পাশে বড় নামফলকে লেখা, ‘খোরশেদের গরুর মাংসের দোকান, প্রতি কেজি ৬০০ টাকা’। এই দোকানে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে গতকাল ক্রেতারা মাংস কিনছিলেন। খোরশেদ আলমের গরুর মাংস বিক্রির ধরনও আলাদা। কোরবানির ক্ষেত্রে যেমনটা করা হয়, তেমনই গরুর হাড়-মাংস, কলিজা, চর্বির সঙ্গে মাথার মাংস মিশিয়ে এক দাম ৬০০ টাকায় প্রতি কেজি মাংস বিক্রি করছেন তিনি। দেখা গেল, ১২ থেকে ১৫ জন কসাই টানা কাজ করছেন এই দোকানে। পাশের দোকান আর রাস্তায় বাঁধা আছে ৬টি গরু।
খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে দিনে ২ থেকে ৩টি গরু বিক্রি করতেই কষ্ট হতো। এখন দিনে ১২ থেকে ১৫টি গরু জবাই দিতে হচ্ছে। বিক্রিতে বেশি চাপ হওয়ায় আমরা হাড়-মাংস একসঙ্গে করে দিচ্ছি। তারপরও সবাই কিনছেন। অনেকটা উৎসবের মতো বেচাবিক্রি হচ্ছে।’ খোরশেদ আলম জানালেন, প্রতি কেজি মাংস বিক্রিতে তাঁর লাভ আগের তুলনায় কমেছে, তবে ক্রেতারা গরুর মাংসের দোকানমুখী হওয়ার কারণে তিনি ব্যবসার ভালো সম্ভাবনা দেখছেন।
শাহজাহানপুরের গরুর মাংসের বিক্রেতা সোহেল আহমেদের অভিজ্ঞতাও প্রায় একই। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গরুর মাংসের দাম যখন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি রাখা হচ্ছিল, তখন অনেকে মাংস না কিনে ফিরে যেতেন। এখন যাঁরাই দোকানে আসেন, তাঁরা সবাই কমবেশি মাংস কিনছেন। তাতে তাঁর বেচাকেনা বেড়েছে তিন থেকে চার গুণ। তবে ভবিষ্যতে বেচাকেনার এই ধারা না থাকলে কম লাভে তিনি মাংস বিক্রি করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তাঁর সংশয় রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৭ লাখ টন। ওই বছর দেশের বাজারে মাংসের চাহিদা ছিল ৭৬ লাখ টন। ফলে চাহিদার তুলনায় ১১ লাখ টন বেশি মাংস উৎপাদিত হয়েছে। তবে এই মাংসের একটি বড় অংশই উৎপাদিত ও খাওয়া হয় ঈদুল আজহার সময়।