সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিক এপ্রিল–জুনে দেশের শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির গতি অনেকটা কমে গেছে। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তা আড়াই গুণ কমেছে। শিল্পের শ্লথগতির কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে দেশের শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ, অর্থাৎ গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৫৫ গুণ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। সে হিসাবে গত জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকের চেয়ে এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫৭ গুণ কমেছে।
সরকারের আমদানি নিয়ন্ত্রণনীতি এবং শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে এই খাতে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্প খাতের হিস্যা যখন ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, তখন এই খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সোমবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক এপ্রিল-জুনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ, অর্থাৎ সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বেশ কমেছে।
দেশে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম এবং বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির থাকলেও এত দিন উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। চতুর্থ প্রান্তিকে এসে যেটা দেখা গেল, সেটাই সম্ভবত বাস্তবতা।মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে অবকাঠামো খাতের সংকোচন। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কয়েকটি উপখাতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে– খনি ও খনন, শিল্পের উৎপাদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সরবরাহ এবং অবকাঠামো। গত অর্থবছরের সর্বশেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল–জুলাই) মোট জিডিপিতে অবকাঠামো খাতের অবদান ছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকার, যা আগের প্রান্তিকের চেয়ে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। একইভাবে আগের প্রান্তিকের চেয়ে উৎপাদন কমেছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার।
তবে গত অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। এই খাতে প্রবৃদ্ধির হয় ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেবা খাতে, মাত্র ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে শিল্পের প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ার সঙ্গে পরিসংখ্যানগত সংশোধনের প্রভাব আছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অর্থনীতিবিদেরা সব সময় অভিযোগ করেছেন, পরিসংখ্যান ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে শিল্পে যে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, তা বেশি বলেই মনে হয়। বার্ষিক হিসাব প্রকাশিত হলে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, দেশে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম এবং বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির থাকলেও এত দিন উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। চতুর্থ প্রান্তিকে এসে যেটা দেখা গেল, সেটাই সম্ভবত বাস্তবতা। তাঁর মতে, প্রবৃদ্ধি কমার আরও কারণ রয়েছে। যেমন দেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে সরকার আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রেখেছে। আমদানি কমে গেলে শিল্পের প্রবৃদ্ধি বাড়বে কী করে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ২২ ও ২ দশমিক ৯১ শতাংশ, অর্থাৎ গত অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার অনেকটা ওঠানামা করেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে দেশের শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ, ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ বা চতুর্থ প্রান্তিকে শিল্পের উপখাতগুলোর মধ্যে দুটির সংকোচন ঘটেছে ও দুটিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সংকোচন হয়েছে খনি ও নির্মাণ খাতে। অন্যদিকে উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানি সরবরাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বিশেষ করে নির্মাণ খাতের সংকোচন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই খাতে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়। গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে এই খাতের প্রবৃদ্ধির সংকোচন ঘটেছে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। যদিও আগের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
২০২৩–২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, কর্মে নিয়োজিত মোট জনশক্তি কমেছে। সেই সঙ্গে উৎপাদনশীলতাও কমছে বলে মনে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
আলোচ্য অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয় যথাক্রমে ৫ দশমিক ০৭, ৫ দশমিক ৭৮ ও ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৩, ৬ দশমিক ৩৭ ও ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।