বেশি গরম পড়লে শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট বাড়ে। তীব্র তাপপ্রবাহ ও আর্দ্রতার কারণে খেটে খাওয়া মানুষেরা সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়েন; স্বাভাবিক সময়ের মতো কাজ করতে পারেন না। এতে তাঁদের আয় কমে। সার্বিকভাবে ক্ষতি হয় অর্থনীতির।
তাপপ্রবাহের কারণে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। সার্বিকভাবে প্রভাব পড়ে অর্থনৈতিক উৎপাদনেও। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় ঢাকা শহরের অর্থনৈতিক ক্ষতি বেশি হয়। তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকা শহরের জিডিপির ৮ শতাংশ ক্ষতি হয়—বছরে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজার দরে (প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশ বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।
২০২২ সালের শেষের দিকে ঢাকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ১২টি বড় শহরে তাপপ্রবাহের কারণে অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হয়, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার। সেখানে এই চিত্র উঠে এসেছে।
গত ১৫ দিনের বেশি সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সব জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। গত সপ্তাহে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে মানুষের, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের। ফলে দেড় বছর আগের ওই প্রতিবেদন এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
প্রতিবেদনে উল্লেখিত ১২ শহরের তালিকায় আছে ঢাকা, যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও মিয়ামি; যুক্তরাজ্যের লন্ডন; অস্ট্রেলিয়ার সিডনি; ভারতের দিল্লি; চিলির সান্তিয়াগো; থাইল্যান্ডের ব্যাংকক; আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস; মেক্সিকোর মন্টেরি; গ্রিসের এথেন্স ও সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন।
জিডিপির অনুপাতে ক্ষতির দিক থেকে এ ১২টি শহরের মধ্যে শীর্ষে আছে ঢাকা। ঢাকার পরে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনের ক্ষতি হয় জিডিপির ৬ শতাংশ; অন্যান্য শহরের ক্ষতি ১ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে।
একেক শহরের মানুষের কাছে তাপপ্রবাহের অনুভূতি একেক রকম। কোনো শহরে বছরে কমপক্ষে যদি ১০ দিন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নাগরিকের শরীরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি হয়, এমন পরিস্থিতি বিপজ্জনক ধরা হয়।
অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, উচ্চ তাপপ্রবাহের কারণে ওই ১২টি শহরের মধ্যে ঢাকার ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। তাপপ্রবাহ ও আর্দ্রতায় পোশাক ও পরিবহন খাত ও খুচরা ব্যবসায় নিয়োজিত কর্মজীবীরা সবচেয়ে বেশি ভোগেন। এ সময় তাঁদের আয় প্রায় ১০ শতাংশ কমে যায়।
ঢাকা শহরে পরিবহন খাতের ক্ষতি হয় ১০ শতাংশ বা ১৮০ কোটি ডলার আর পোশাক খাতের ক্ষতি হয় ১৫০ কোটি ডলার, যা এই খাতের মোট অবদানের ৯ শতাংশ। তাপপ্রবাহ এভাবেই উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে।
শ্রমিকদের কারখানায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। কারখানার ছাদ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপযোগী নয়, বরং ছাদ তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। পরিবহনশ্রমিক, খুচরা বিক্রেতাদের তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই সুরক্ষা ছাড়া কাজ করতে হয়। এসব কারণে তাঁদের শ্রম উৎপাদনশীলতা কমে যায়—এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিক কর্মপরিবেশের অবনমন হলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতায় প্রভাব পড়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেও কর্মপরিবেশ বিঘ্নিত হয়। উৎপাদন কমবে—এটাই গ্রহণযোগ্য, যা জাতীয় আয়ে প্রভাব ফেলছে। তিনি মনে করেন, ঢাকা শহরে সেবা খাত থেকেই অর্থনীতিতে বেশি মূল্য সংযোজিত হয়। কলকারখানায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়; পাশাপাশি এটিকে সামাজিক ইস্যু হিসেবেও দেখতে হবে। কর্মবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে নজর দিতে হবে, অর্থাৎ ভবনগুলো যেন পরিবেশবান্ধব হয়।
শুধু এখন নয়, ২০৫০ সালে তাপপ্রবাহে অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হবে, অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের প্রতিবেদনে তা–ও উল্লেখ করা হয়েছে। আরও ২৬ বছর পর, অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে রাজধানী ঢাকার ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
এবার দেখা যাক, প্রতিবেদনে উল্লেখিত অন্যান্য শহরের ক্ষতির কথা কী বলা হয়েছে। পাশের দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লির বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ এখন ৩৯০ কোটি ডলার। তাপমাত্রা কমানোসহ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬১০ ডলার।
প্রচণ্ড গরমের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও মিয়ামিতে বছরে ক্ষতি হয় যথাক্রমে ৫০০ কোটি ডলার ও এক হাজার কোটি ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরের বার্ষিক ক্ষতি হয় ৭৩ কোটি ডলার। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এই ক্ষতির পরিমাণ ৩১ কোটি ডলার। ব্যাংককে এই ক্ষতির পরিমাণ ৪০০ কোটি ডলার।
এ ছাড়া তীব্র তাপপ্রবাহে চিলির সান্তিয়াগো শহরের ক্ষতি হয় ১০ কোটি ডলার, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের সাড়ে ১১ কোটি ডলার, মেক্সিকোর মনটেরির ১৮০ কোটি ডলার, গ্রিসের এথেন্সের ১০ কোটি ডলার ও সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনের ৩ কোটি ডলার ক্ষতি হয়।