আগামী ৩০ জুন চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হচ্ছে। তাই এখনই একটু চিন্তাভাবনা করা উচিত। কারণ, একটু কৌশলী হলেই আপনি করের বোঝা কমাতে পারবেন। কোথায়, কোথায় বিনিয়োগ করে কীভাবে কর কমাবেন তা নিয়েই এই প্রতিবেদন
আগামী ৩০ জুন চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হচ্ছে। গত বছরের ১ জুলাই থেকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে করদাতার আয়-ব্যয়ের হিসাবের ভিত্তিতেই পরে করারোপ করা হবে। তাই এখনই একটু চিন্তাভাবনা করা উচিত। কারণ, একটু কৌশলী হলেই আপনি করের বোঝা কমাতে পারবেন। আবার নতুন করদাতারা আগামী ৩০ জুনের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। তাই দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
এ ছাড়া ৩০ জুনের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিসেবার বেশ কিছু খাতের কর অবকাশ সুবিধা উঠে যাচ্ছে। তাই আগামী ৩০ জুনের আগেই কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করে উৎপাদন বা সেবায় গেলে আগামী ১০ বছর কর অবকাশ পাবেন। সময় আছে আর মাত্র দেড় মাস।
গত ১০ মাসে আপনি কত টাকা আয় করলেন, সেটিও হিসাব করে দেখতে পারেন। তাহলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, গতবারের চেয়ে কর কমবে না বাড়বে। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনাও করতে পারবেন। নতুন বাজেটের দিকেও খেয়াল রাখুন। তাহলে সহজেই করের হিসাব-নিকাশ করে ফেলতে পারবেন।
বিনিয়োগর কথা ভাবুন
বর্তমানে আয়কর আইনের যেসব বিধান কার্যকর রয়েছে, তাতে বৈধ পথে নানা খাতে বিনিয়োগ করেও চাইলে আপনি আপনার করের বোঝা কিছুটা হলেও কমাতে পারেন। এ জন্য আপনাকে বিদ্যমান সুবিধাগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। সারা বছরের আয় থেকে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে কোথাও বিনিয়োগ করুন। দেখবেন, আপনার কর কমে গেছে।
কোথায়, কোথায় বিনিয়োগ করে কীভাবে কর কমাবেন, তার কিছু খাত সম্পর্কে তবে জেনে নেওয়া যাক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে এমন কিছু খাত ঘোষণা করা আছে, যেখানে বিনিয়োগ করলে অনেক টাকা করছাড় বা কর রেয়াত পাবেন।
ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ করদাতাদের জন্য সঞ্চয়পত্র কিংবা মাসিক সঞ্চয় বা পেনশন স্কিম বা ডিপিএস করা হলো কর কমানোর অন্যতম সহজ কৌশল। সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি হওয়ায় তুলনামূলক আপনি বেশি মুনাফা পাবেন, আবার করছাড়ও পাবেন। আপনি মাসে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিপিএস করলেও সেই টাকার ওপর কর ছাড় পাবেন। আবার দুটি খাতেই বিনিয়োগ করতে পারবেন।
নিয়ম হলো, একজন করদাতা তাঁর বছরের পুরো আয়ের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারেন। এ সুবিধার আওতায় আপনার বিনিয়োগের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ করছাড় পাবেন। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে করছাড়ের পরিমাণ কোনোভাবেই ১০ লাখ টাকার বেশি হবে না।
ধরুন, গত জুলাই থেকে জুন মাস পর্যন্ত আপনি ১০ লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। পুরোটাই আপনার করযোগ্য আয়। আপনি এই আয়ের ২০ শতাংশ বা ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন। আপনি সারা বছর একটু একটু খরচ বাঁচিয়ে ২ লাখ টাকাই বিনিয়োগ করলেন। তাহলে আপনি আপনার কর থেকে ৩০ হাজার টাকা (বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ হিসেবে) ছাড় পাবেন।
এবার দেখা যাক, আপনি বিনিয়োগ না করলে কত কর হতো। প্রথম সাড়ে ৩ লাখ টাকার জন্য কোনো কর নেই। এর মানে, আপনার বাকি সাড়ে ৬ লাখ টাকা আয়ের ওপর কর বসবে। সেই টাকার প্রথম ১ লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ হারে ৫ হাজার টাকা। পরের ৩ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে ৩০ হাজার টাকা। বাকি আড়াই লাখ টাকার ১৫ শতাংশ হারে সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে আপনার করের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ৭২ হাজার টাকা।
কিন্তু আপনি যেহেতু বিনিয়োগ করেছেন, তাই আপনি ৩০ হাজার টাকা ছাড় পাবেন। তাই আপনাকে দিতে হবে সাড়ে ৪২ হাজার টাকা কর। শুধু বিনিয়োগ করার কারণে এই ছাড় মিলবে।
খাতগুলো কী
এনবিআর করছাড় নেওয়ার জন্য ৯টি খাত ঠিক করে দিয়েছে। তার একটি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, কমবেশি সব করদাতা তা জানেন। এর বাইরে আরও আটটি খাত আছে। এগুলো হলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চার ক্রয়; জীবনবিমার প্রিমিয়াম; সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্য তহবিলের চাঁদা; স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলে নিয়োগকর্তা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাঁদা; কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠীবিমার তহবিলে চাঁদা; সরকার অনুমোদিত ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ এবং সুপার অ্যানুয়েশন ফান্ডে চাঁদা। আর ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সঞ্চয় করলেও কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। ডিপিএসের ওপর বার্ষিক সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকার ওপর এই করছাড় দেওয়া আছে।
দান করলেও আছে করছাড়
নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ, দান করেও করছাড় সুবিধা নেওয়া যায়। অনেকেই বিভিন্ন খাতে দান করেন। একটু ভেবেচিন্তে দান করলে তার বিপরীতে নিজের কর কমিয়ে ফেলতে পারবেন। সরকার ১৩টি খাতে দান করলে করছাড় সুবিধা দেয়। এগুলো হলো জাতির জনকের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান; জাকাত তহবিল; জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুমোদিত দাতব্য হাসপাতাল; প্রতিদ্বন্দ্বীদের কল্যাণে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক; আহছানিয়া ক্যানসার হাসপাতাল; ঢাকা আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল; এশিয়াটিক সোসাইটি; আইসিডিডিআরবি; সিআরপি; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান এবং সরকার অনুমোদিত জনকল্যাণমূলক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
নতুন করদাতারা ৩০ জুন পর্যন্ত রিটার্ন দিতে পারবেন
নতুন করদাতাদের জন্য নতুন আয়কর আইনে সুখবর আছে। আপনি যদি এ বছর প্রথম কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেন এবং প্রথমবার কর দেওয়ার যোগ্য হন; তাহলে আপনাকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি আগামী ৩০ জুনের মধ্যে রিটার্ন জমা দিলেই হবে। নতুন করদাতাদের জন্য এই ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর দেড় মাসের মতো সময় আছে। নতুন করদাতা যাঁরা এখনো রিটার্ন দেননি, তাঁরা ৩০ জুনের মধ্যে এ সুবিধা নিতে পারেন।
বর্তমানে এক লাখের বেশি টিআইএনধারী আছেন। গত এক বছরের প্রায় ১৫ লাখ নতুন টিআইএনধারী করজালে যুক্ত হয়েছেন।
সামনের বছরের প্রস্তুতি
আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের রিটার্ন জমা, করহার, কর দেওয়ার প্রক্রিয়া—এসব খাতে যেসব পরিবর্তন আসবে; তা আগামী মৌসুমে রিটার্ন দেওয়ার সময় মনে করে রাখতে হবে। অর্থাৎ আসন্ন বাজেটে যেসব পরিবর্তন হচ্ছে, তা আগামী ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রিটার্ন দেওয়ার সময় প্রযোজ্য হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা বহাল থাকতে পারে। এর ফলে এবারের মতো আগামী মৌসুমেও করদাতাদের বার্ষিক মোট আয় থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা বাদ দিয়ে বাকি টাকার ওপর কর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে করদাতাদের সুখবর না-ও থাকতে পারে। আরও খারাপ খবর আসতে পারে আগামী বাজেটে। যেমন এখন বার্ষিক আয়ের সাড়ে ৩ লাখ টাকা করমুক্ত থাকার পর প্রথম ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। এই সুযোগ না-ও থাকতে পারে। প্রথম ৪ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর বসতে পারে। এ ছাড়া কর আরোপযোগ্য আয় ১৮ লাখ টাকা পেরোলেই বাকি টাকার ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর বসতে পারে।