২০২২ সালে হাজারে প্রায় ১১ জন শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। গত বছর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজারে প্রায় ১৪।
করোনা মহামারির সময় মানুষের মধ্যে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। পরে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মানুষের শহর ছাড়ার প্রবণতা কমেনি; বরং আর্থসামাজিক কারণে বছর বছর শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালে প্রতি হাজারের মধ্যে প্রায় ৬ জন শহর থেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে প্রায় ১৪।
বিবিএসের পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ প্রতিবেদনে অভিবাসন বিষয়ে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য বিবিএস ৩ লাখ ৮ হাজার ৩২টি পরিবারের ওপরে সমীক্ষা চালিয়ে এ তথ্য পেয়েছে।
শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়লেও গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল প্রতি হাজারে ২৬ দশমিক ৪। ২০২৩ সালে তা কমে নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ২০ জনে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সাধারণত অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে কাজের জন্য মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর হন। এ ছাড়া উন্নত জীবনযাপন ও বিয়ের মতো সামাজিক কারণেও মানুষ স্থান পরিবর্তন করেন। বিবিএসের হিসাবে দেখা যায়, ২০২৩ সালে প্রতি ১ হাজার জনের মধ্যে ১৩ দশমিক ৮ জন বা প্রায় ১৪ জন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছেন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল হাজারে ১০ দশমিক ৯; অর্থাৎ এ বছরের ব্যবধানে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা হাজারে বেড়েছে প্রায় ৩।
শুধু যে অর্থনৈতিক কারণে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, তা নয়; যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কারণেও অনেক মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের বড় শহরগুলোর সঙ্গে আশপাশের জেলার যোগাযোগ এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে। এ কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। আবার শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেকে পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন খরচের চাপ সামলাতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষের আয়ের তুলনায় এখন ব্যয় অনেক বেশি। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত হয়ে গেছে। এ কারণে তুলনামূলক নিরাপদ আশ্রয় ভেবে গ্রামমুখী হচ্ছেন অনেকে। সেই সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যাও কমেছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় আয় বাড়েনি। ফলে উচ্চ ব্যয় সংকুলানের জন্য উপযোগী কাজের অভাবে মানুষ গ্রামমুখী হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে সরকারি সুরক্ষা সহায়তার পরিধি ও পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, গত কয়েক বছরে শহর এলাকায় পর্যাপ্ত চাকরি সৃষ্টি হয়নি; বরং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অনেক খাতে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এতে নিম্নবিত্ত মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যাঁরা দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে ছিলেন, তাঁরা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছেন। তারই প্রভাব দেখা যাচ্ছে গ্রামমুখী অভিবাসনে।
দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল প্রতি হাজারে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯ ও শূন্য দশমিক ৭। এরপর করোনার বিস্তার শুরু হলে ২০২০ সালে তা বেড়ে হাজারে ৮ দশমিক ৪ জনে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে এই প্রবণতা কিছুটা কমে। তবে ২০২২ সালে শহর থেকে গ্রামে স্থানান্তর বেড়ে যায়। গত বছরও সেই ধারা অব্যাহত ছিল।
অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে গ্রামে আবার শহর থেকে শহরে ও গ্রাম থেকে শহরে মধ্যে নিয়মিত মানুষের অভিবাসন বা স্থান বদলের ঘটনা ঘটে। বিবিএসের জরিপে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ক্ষেত্রে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যায় কেবল বেড়েছে। অন্যান্য অভিবাসন সেভাবে বাড়েনি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কমেছে।
যেমন ২০২২ সালে গ্রাম থেকে গ্রামে স্থানান্তর হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল হাজারে ৯ দশমিক ৩। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৬ জনে। একইভাবে ২০২২ সালে শহর থেকে শহরে স্থানান্তর হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল হাজারে ৩৮ দশমিক ৪। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৮ জনে।
শুধু যে দেশের মধ্যে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে তা নয়, দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়া; অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে স্থানান্তর হওয়া মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০২২ সালে প্রতি হাজার ৬ দশমিক ৬১ জন মানুষ আন্তর্জাতিক অভিবাসী হয়ে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। গত বছর এ সংখ্যা বেড়ে হাজার ৮ দশমিক ৭৮-এ উন্নীত হয়েছে।