বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এ সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি আমানতের সুদহারের সর্বনিম্ন সীমাও তুলে নিয়েছে।
চলমান অর্থনৈতিক সংকটে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের যেসব মানুষ ব্যাংকঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি চাপ সামাল দিচ্ছেন, তাঁদের জন্য নতুন করে দুঃসংবাদ দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, সব ধরনের ভোক্তাঋণের সুদহার আরও ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে এখন থেকে ভোক্তা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি সুদ দিতে হবে। আগে এসব ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ৯ শতাংশ। ফলে ভোক্তাঋণে সুদ বেড়ে হলো ১২ শতাংশ।
পাশাপাশি আমানতের সুদহারের সীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
ফলে এখন থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী আমানতে সুদ দিতে পারবে। আগে মেয়াদি আমানতে সুদহার তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হবে না বলে জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও সেই অনুযায়ী বাড়েনি সুদহার।
এত দিন ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ভোক্তাঋণসহ সব ধরনের ঋণের সুদ ৯ শতাংশে বেঁধে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন করে ভোক্তাঋণে সুদ বাড়ানো হলেও অন্য ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল রোববার নতুন যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, সেখানে ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর এ ঘোষণা দেওয়া হয়। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার প্রথমবারের মতো ২০২২-২৩ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য এই ঘোষণা দেন।
নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার পুরোপুরি তুলে নেওয়া হলো। আর ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। এতে ব্যাংকগুলো এখন থেকে ভোক্তাঋণ সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদ আদায় করতে পারবে। এতে চিকিৎসা ঋণ থেকে শুরু করে গাড়ি কেনা, শিক্ষাঋণসহ সব ধরনের ভোক্তাঋণে খরচ বাড়বে। সাধারণত এ ধরনের ঋণকে অনুৎপাদনশীল ঋণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন ভোক্তাঋণের পাশাপাশি এরই মধ্যে যাঁরা এ ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও নতুন সুদহার কার্যকর হবে।
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের এ–সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ কোনোভাবেই তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হতে পারবে না। আর ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হিসাব অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—এ তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮২ শতাংশের বেশি। তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সীমা অনুযায়ী আমানতের সুদহার এ গড় মূল্যস্ফীতির কম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ দিচ্ছিল সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। ফলে আমানতের সুদ নিয়ে একধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে ব্যাংকগুলো।
কারণ, ৮ শতাংশের বেশি সুদে আমানত নিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহারটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সুদের এ সীমা তুলে নিল।
সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকে বাড়তি খরচ সামাল দিতে বাধ্য হয়ে ব্যাংকঋণে ঝুঁকেছেন। এ কারণে ভোক্তা ঋণও বাড়ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাস জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ভোক্তাঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকগুলোতে ভোক্তাঋণের স্থিতি ছিল ৯৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকায়।
এদিকে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ানোর কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ঋণের খরচও বাড়বে—তাতে এ শ্রেণি আবারও চাপে পড়বে। অথচ শিল্পমালিক বা ব্যবসার ঋণের সুদ একই রাখা হয়েছে—এটি কেন? এ বিষয়ে গতকাল গভর্নরকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। জবাবে গভর্নর বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য চাহিদা কমানো। এ জন্য ভোক্তা ঋণের সুদ বাড়ানো হয়েছে।
অর্থনীতির পরিস্থিতি ভালো হলে শিল্পঋণের সুদের সীমাও তুলে দেওয়া হবে। আমরা ভালো পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছি। ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কে বিনিয়োগ করবে। সুদ বাড়ানো হলে রপ্তানি কমে যাবে, অনেকে প্রতিযোগিতা–সক্ষমতা হারাবে।