গত এক যুগে করপোরেশনগুলো ২১ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। অর্থনীতিবিদদের দাবি, করপোরেশনের সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীন থাকা ২৬টি পাটকল ২০২০ সালে বন্ধ করে দেয় সরকার। পাটকল বন্ধ হলেও বিজেএমসির লোকসান তো কমেইনি; বরং বেড়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে করপোরেশনটির লোকসান ছিল প্রায় ২১৩ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সেই লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২৫ কোটি টাকায়।
সরকারের কলকারখানা পরিচালনার জন্য বিজেএমসিসহ ছয়টি করপোরেশন রয়েছে। এর মধ্যে চারটি বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) করপোরেশনগুলো সম্মিলিতভাবে নিট লোকসান করেছে ২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে এসব করপোরেশনের সম্মিলিত লোকসান ছিল ১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, বিজেএমসি গত ১৭ বছরের মধ্যে শুধু ২০১০-১১ অর্থবছরে মুনাফা করেছিল। বাংলাদেশ বস্ত্রকল করপোরেশন (বিটিএমসি) ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) ১৭ বছর ধরে লোকসান গুনছে। টানা ৯ বছর মুনাফার মুখ দেখেনি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) টানা তিন বছর লোকসানের পর চলতি বছর লাভের মুখ দেখেছে। আর বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি) টানা চার বছর মুনাফা করছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করলেও করপোরেশনের অধীন থাকা বেশির ভাগ কারখানা তা পারছে না। এমনকি কারখানা বন্ধ থাকলেও বছরের পর বছর লোকসান গুনছে একাধিক করপোরেশন। ফলে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের লোকসানের দায় নিতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখতে জনগণের করের টাকায় ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ দায় বহনের সুযোগ নেই। ধীরে ধীরে করপোরেশনগুলো গুটিয়ে না নিলে ভবিষ্যতে এগুলো মাথাব্যথার কারণ হবে দাঁড়াবে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, গত এক যুগে ছয় করপোরেশন ২১ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এ সময়ে মাত্র সাড়ে ৫৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ বাবদ জমা হয়েছে সরকারের কোষাগারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লোকসানি সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। করপোরেশনটির অধীন ১৩টি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। আর ৯টি শিল্পকারখানা চলে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে। বর্তমানে বিসিআইসির কারখানাগুলোর উৎপাদিত মূল পণ্য সার। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকার সার বিক্রি করেছে বিসিআইসি। যদিও এই পরিমাণ সার উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিসিআইসির নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছর তাদের লোকসান ছিল ৮৭৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে করপোরেশনটির লোকসান ৬৩৪ কোটি টাকা বেড়েছে।
বিসিআইসির পর বেশি লোকসান করেছে বিএসএফআইসি। তাদের হাতে রয়েছে ১৮টি কারখানা। তার মধ্যে ১৫টি চিনিকল গত ১৭ বছরে কখনোই মুনাফা করতে পারেনি। তবে স্পিরিট ও মদ বিক্রি করে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি মুনাফা করছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৮০৪ কোটি টাকা চিনি, স্পিরিটসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে করপোরেশনটি। গত অর্থবছর ৫৮২ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছিল। পণ্যের বিক্রি বাড়লেও চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭১ কোটি টাকার লোকসান করেছে বিএসএফআইসি। গত অর্থবছর তাদের লোকসান ছিল ৫৩২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে লোকসান বেড়েছে ৩৯ কোটি টাকা।
বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনতে থাকা বিজেএমসির মালিকানায় থাকা ২৬টি পাটকল ২০২০ সালের ২ জুলাই বন্ধ করে দেয় সরকার। এসব পাটকলের শ্রমিকদেরও ছাঁটাই করা হয়। ইতিমধ্যে বেসরকারি খাতে ইজারা দিয়ে ছয়টি বন্ধ পাটকল চালু হয়েছে। তাতে লোকসানের চক্র থেকে বের হতে পারেনি বিজেএমসি। গত তিন অর্থবছরে ৭২৪ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে করপোরেশনটি।
বিজেএমসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত করপোরেশনটিতে ২ হাজার ৪৬১ জন কর্মরত ছিলেন। ওই অর্থবছরে শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে ব্যয় হয় ১৩৯ কোটি টাকা। কারখানা বন্ধ থাকলে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়ায় লোকসান বাড়ছে করপোরেশনটির।
এর বাইরে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন টানা তিন বছর লোকসানের পর চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেছে। করপোরেশনটি গত এপ্রিল পর্যন্ত মুনাফা করেছে ৬২ কোটি টাকা। বিএসইসির অধীন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজসহ নয়টি শিল্পকারখানা রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি) চলতি অর্থবছর মুনাফা করছে ১২ কোটি টাকা।
বছরের পর বছর ধরে লোকসান করা শিল্পকারখানার বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, নীতিগতভাবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে সরকারের পক্ষে লাভজনকভাবে শিল্পকারখানা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কারণ, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, বাজার–সম্পর্কিত তথ্য না থাকা ও পরিচালনাগত দুর্বলতা সব শিল্পকারখানায় রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে করপোরেশন গুটিয়ে আনা দরকার।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রাজনৈতিকভাবে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে ধীরে ধীরে কার্যক্রম গুটিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে শিল্পকারখানার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা করতে হবে। তারপর ঋণ ও দায়দেনা পরিশোধ করে কারখানা ও জমিজমা দায়মুক্ত করা প্রয়োজন। এরপর সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কিংবা বিসিক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে কিছু জায়গায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, সেখান থেকে ইতিবাচক ফল আসবে।