নতুন আয়কর আইনে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির মতো তহবিলে সাড়ে ২৭ শতাংশ কর বসানো হয়েছে, যা আগে ছিল ৫ থেকে ১০ শতাংশ।
কর আদায় বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর আহরণে এবার সংস্থাটির নজর পড়েছে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) ও আনুতোষিক তহবিলের (গ্র্যাচুইটি ফান্ড) আয়ের ওপর। এই দুটি তহবিলের আয়ের ওপর কর বাড়িয়ে দিয়েছে এনবিআর। এতে বেসরকারি চাকরিজীবীরা ভবিষ্য তহবিলের টাকা তুলতে গেলে আগের চেয়ে কম টাকা পাবেন। অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে এসব তহবিলের আয়ে আগের মতোই করমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এদিকে গ্র্যাচুইটি ফান্ড বা আনুতোষিক তহবিলের ওপর কর বৃদ্ধি করায় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপরও অবশ্য করের চাপ বাড়বে। তবে এ ক্ষেত্রে গ্র্যাচুইটির টাকা কমবে না চাকরিজীবীর। কারণ, চাকরির মেয়াদের প্রতিবছরের হিসাবে গ্র্যাচুইটি পান চাকরিজীবীরা।
নতুন আয়কর আইন এভাবেই বেসরকারি চাকরিজীবী ও নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর করের বাড়তি চাপ তৈরি করবে। ভবিষ্য তহবিলে বেসরকারি চাকরিজীবীরা অর্থ জমান ভবিষ্যতের আর্থিক সুরক্ষার জন্য। প্রতি মাসে বেতনের টাকা থেকে একটি অংশ নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষ চাঁদা হিসেবে কেটে রাখে।
চাকরিজীবীরা সারা জীবন একটু একটু করে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা রাখেন। অবসরের পর এটি সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। এখন বাড়তি কর নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সেই চাকরিজীবীরা।টি আই এম নুরুল কবির, নির্বাহী পরিচালক, এফআইসিসিআই
একই তহবিলে চাকরিজীবীর দেওয়া অর্থের সমপরিমাণ অর্থ জমা দেয় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানও। কর্মীর নিজের জমা অর্থ ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ দুটিই প্রতি মাসে প্রভিডেন্ট ফান্ডের হিসাবে জমা হয়। এই টাকা ফেলে না রেখে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়।
গ্র্যাচুইটি ফান্ডের পুরো টাকা প্রতিষ্ঠান দেয়। কর্মী যখন চাকরি ছেড়ে দেবেন কিংবা অবসর নেবেন, তখন কত বছর চাকরি করলেন, সেই অনুযায়ী প্রতিবছরের জন্য একটি করে মূল বেতনের (সর্বশেষ মূল বেতন) সমপরিমাণ টাকা পান। এখন কর বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিষ্ঠানের শুধু কর বাবদ খরচ বাড়বে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান আনুতোষিক তহবিল বা গ্র্যাচুইটি ফান্ড গঠনে নিরুৎসাহিত হতে পারে। কর্মীর ওপর হয়তো সরাসরি প্রভাব পড়বে না।
অবসরের সময় বা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা উত্তোলনের সময় কোনো কর বসবে না, এমনকি চাকরিজীবনের যেকোনো সময়ে প্রয়োজনে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে ফেললেও কর বসবে না। এ ছাড়া গ্র্যাচুইটির টাকা উত্তোলনের সময়ও কর নেই। এসব টাকা বরাবরের মতো করমুক্ত আয়।
বর্তমানে দেশে প্রায় ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন; কিন্তু বেসরকারি খাতে কত লোক প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিয়ে চাকরি করেন, এর সঠিক কোনো হিসাব নেই। তবে এই সংখ্যা এক কোটির কম নয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে।
নতুন আয়কর আইনে ট্রাস্ট ও তহবিলের আয়ের ওপর প্রতিবছর সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে করপোরেট কর বসানোর বিধান করা হয়েছে। আগের আইনে সমজাতীয় ধারায় শুধু ব্যক্তিসংঘ, আইনের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তি এবং অন্যান্য করারোপযোগ্য সত্তার ওপর বার্ষিক সাড়ে ২৭ শতাংশ করপোরেট কর বসত। এখন নতুন করে দুটি খাত যুক্ত করা হয়েছে।
অবসর নেওয়া বা চাকরি ছেড়ে দেওয়া কিংবা প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে ফেলার সময় বেসরকারি চাকরিজীবীরা যখন এই টাকা তুলবেন, তখন তা কম পাবেন।স্নেহাশীষ বড়ুয়া, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেড
আগেও ট্রাস্ট ও তহবিলের আয়ের ওপর কর বসত, তবে তা কিছুটা ভিন্নভাবে। সাধারণত ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিক তহবিলের অর্থ স্থায়ী আমানতে (এফডিআর) কিংবা সঞ্চয়পত্র ক্রয়সহ বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে খাত ভেদে এ বিনিয়োগের মুনাফার ওপর উৎসে কর হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কর কেটে রাখা হতো।
এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ স্নেহাশীষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি ফান্ডের টাকা বিনিয়োগ করলে যে সুদ বা মুনাফা পাওয়া যেত, তার ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর বসত।
নতুন আইনে এসব তহবিলের আয়ের ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিতে হবে। এতে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীরা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আগের চেয়ে কিছুটা কম পাবেন। অবসর নেওয়া বা চাকরি ছেড়ে দেওয়া কিংবা প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে ফেলার সময় বেসরকারি চাকরিজীবীরা যখন এই টাকা তুলবেন, তখন তা কম পাবেন।
করদাতা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরুন, আপনি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ভবিষ্য তহবিলে প্রতি মাসের বেতন থেকে আড়াই হাজার টাকা জমা রাখেন। প্রতিষ্ঠানও আপনার জন্য আড়াই হাজার টাকা রাখে। দুটি মিলিয়ে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা এবং বছরে ৬০ হাজার টাকা জমা হয়।
এই টাকা কোনো ব্যাংকে এফডিআর হিসাবে জমা রাখলে বছরে যদি ১০ শতাংশ বা ৬ হাজার টাকা মুনাফা পাওয়া যায়। তাহলে আগে ১০ শতাংশ হিসেবে উৎসে কর কেটে রাখা হতো ৬০০ টাকা। চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছর থেকে হিসাবটি পাল্টে যাবে। বছর শেষে আপনার ভবিষ্য তহবিলের অংশের ওপর মোট কর বসবে ১ হাজার ৬৫০ টাকা। উৎসে করের ৬০০ টাকা বাদ দিলে আপনাকে ১ হাজার ৫০ টাকা বাড়তি কর দিতে হবে। এর মানে, নতুন নিয়মে এক বছরে আপনার লোকসান হবে ১ হাজার ৫০ টাকা।
এসব তহবিলের করপোরেট কর কীভাবে জমা দেওয়া হবে, তা নিয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই আইনে। প্রতিষ্ঠান আনুতোষিক তহবিল বা ভবিষ্য তহবিলের জন্য আলাদা করে টিআইএন নিয়ে রিটার্ন জমা দিয়ে করপোরেট কর দেবে, নাকি প্রতিষ্ঠানের করের সঙ্গে সমন্বয় করে কর দেবে—এ সম্পর্কে এনবিআরের এ বছরের আয়কর নির্দেশিকায় কোনো কিছু বলা হয়নি।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, এটি একধরনের বৈষম্য। সরকারি কর্মকর্তাদের কর দিতে হবে না; কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবীদের বাড়তি কর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, চাকরিজীবীরা সারা জীবন একটু একটু করে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা রাখেন। অবসরের পর এটি সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। এখন বাড়তি কর নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সেই চাকরিজীবীরা।
এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) সামস উদ্দিন আহমেদকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আবার আয়কর বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও তাঁরা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। তবে এ রকম একাধিক কর্মকর্তা ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিক তহবিলের ওপর কর বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
একজন উচ্চপদস্থ আয়কর কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের কল্যাণের জন্য এনবিআর তথা রাষ্ট্র কর নেয়; কিন্তু এখন জনগণের কল্যাণ তহবিল থেকে কর নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, অবসর নেওয়ার সময় পাওয়া ভবিষ্য তহবিল ও আনুতোষিক তহবিলের অর্থ খুব কাজে লাগে। এবার সেখানেও কর বাড়ানো হলো। এটি প্রগতিশীল কর–ব্যবস্থার পরিপন্থী।