দুই বছর পর পণ্য আমদানি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ৫.৭৭ শতাংশ।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার–সংকটে একটানা দুই বছর দেশে পণ্য আমদানি কমে গিয়েছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিশ্চয়তার কারণে এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল গত বছরও। তবে নির্বাচনের পর এখন পণ্য আমদানি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পণ্য আমদানি বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া গেছে।
আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপের মধ্যেও পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলার–সংকট আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। ব্যবসায়ীদেরও ঋণপত্র খুলতে আগের মতো কঠোর নিয়ন্ত্রণের মুখে পড়তে হচ্ছে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে পণ্য আমদানি হয়েছে ৪ কোটি ৫৮ লাখ টন। ২০২৩ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৪ কোটি ৩৩ লাখ টন। এই হিসাবে পণ্য আমদানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অবশ্য গত বছরের তুলনায় পণ্য আমদানি বাড়লেও এখনো আমদানি রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফেরেনি।
বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি সেভাবে বাড়েনি। বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য দেখা যাবে না।মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি
আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য ছিল ২ হাজার ৪০৩ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৬২ কোটি ডলার। অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ।
পণ্য ও খাতভিত্তিক আমদানির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল তুলা, ইস্পাতের কাঁচামাল লোহার টুকরা, প্রাণিখাদ্য সয়াবিনবীজ, ভোগ্যপণ্য গম, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কয়লা, প্লাস্টিক শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি বেড়েছে। আবার সিমেন্টশিল্পের কাঁচামালের আমদানি এখনো কম। পুরোনো জাহাজ আমদানিও কমেছে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়লেও কমেছে শিল্পকারখানার বয়লারসহ যন্ত্রপাতি আমদানি। সামগ্রিকভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কম। অর্থাৎ মোট আমদানি বাড়লেও পণ্য ও খাতভিত্তিক আমদানিতে মিশ্র প্রবণতা রয়েছে।
জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বা এমজিআইয়ের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, পণ্যের চাহিদা থাকলেও কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে এত দিন আমদানি কমেছিল। তবে গত বছরের চেয়ে ডলার–সংকট ও ডলারের দামের অস্থিরতা কিছুটা কমেছে। আমদানি দায় শোধে এখন ১১৪–১১৫ টাকায় ডলার পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংকে। এসব কারণে আমদানিতে ইতিবাচক ধারা ফিরে আসছে। তবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সরকারের আরও নমনীয় হওয়া উচিত। কারণ, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়লে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। অর্থনীতিতে গতি আসবে।
দুই বছর পর আমদানিতে ইতিবাচক ধারা
পণ্য আমদানি, বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো দেশে শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া। যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লে বিনিয়োগ বাড়ে। বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি বাড়লে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পণ্য আমদানিতে নানা জটিলতা তৈরি হয়। তাতে বছর শেষে পণ্য আমদানি ২০২১ সালের তুলনায় আড়াই শতাংশ কমে গিয়েছিল। ২০২১ সালে পণ্য আমদানি হয়েছিল ১৪ কোটি ৩৬ লাখ টন। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ কোটি টনে। ২০২৩ সালেও নিম্নমুখী এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল। গত বছর দেশে ১৩ কোটি ৩৭ লাখ টন পণ্য আমদানি হয়েছিল। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় আমদানি সাড়ে ৪ শতাংশ কম ছিল। কিন্তু চলতি বছরের শুরুর কয়েক মাসে আমদানিতে কিছুটা ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে।
আমদানি বেড়েছে যেসব খাতে
এনবিআরের হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তুলা আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৫৭ হাজার টন। অর্থাৎ তুলা আমদানি বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ।
প্রাণিখাদ্য ও সয়াবিন তেল তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনবীজের আমদানিও বেড়েছে। চলতি বছরে ওপরে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সয়াবিনবীজ আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার টন। এ ক্ষেত্রে আমদানি বেড়েছে ১৩১ শতাংশ।
এ বছর রড তৈরির কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টন। গত বছর একই সময়ে ছিল ৯ লাখ ৪৭ হাজার টন। এ খাতে আমদানি বেড়েছে ৪৮ শতাংশ।
বিদ্যুতের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কয়লা আমদানিও বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। এ বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল) কয়লা আমদানি হয়েছে ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ে এ আমদানির পরিমাণ ছিল ২৮ লাখ ১৯ হাজার টন।
ভোগ্যপণ্যের মধ্যে গমের আমদানিও বেড়েছে ৬২ শতাংশ। এ বছর গম আমদানি হয়েছে ২৭ লাখ ৩৯ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার টন। গমের তৈরি খাদ্যপণ্য দেশে ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়।
আমদানি কমার গতি শ্লথ
গত দুই বছর যেসব খাতে আমদানি দ্রুত কমছিল, সেসব খাতে আমদানি কমার হার এ বছর কমে আসছে। সিমেন্টশিল্পের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের কথাই ধরা যাক। এ খাতে আমদানি কমার হার এখন ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ক্লিংকার আমদানি হয় ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৭৭ লাখ ৭৪ হাজার টন। সেই হিসাবে আমদানি কমেছে ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
অপরিশোধিত চিনি আমদানি কমেছে ৩১ শতাংশ। এবার চিনি আমদানি হয় ৪ লাখ ১৯ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬ লাখ ১০ হাজার টন। জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, চিনির চাহিদা কমেছে। আবার প্রতিবেশী দেশ থেকে অবৈধভাবে চিনি আসছে। এ জন্য আমদানি কমে গেছে।
শিল্পকারখানার বয়লারসহ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। এ বছরের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৫৭ কোটি ডলারের ২ লাখ ৮৭ হাজার টন ওজনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৩০১ কোটি ডলারের ২ লাখ ৯৬ হাজার টন ওজনের যন্ত্রপাতি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সামগ্রিকভাবে পণ্য আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পণ্য আমদানি বাড়লেও আমরা এখনো রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি সেভাবে বাড়েনি। বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য দেখা যাবে না।