ঋণ পুনঃ তফসিল: ১ কোটি টাকা না দিলে নির্বাচন করতে পারতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী 

বিডি থাই ফুড স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পারিবারিক কোম্পানি। অগ্রণী ব্যাংকের কাছে কোম্পানিটি ১৩১ কোটি টাকার খেলাপি ছিল। 

জাহিদ মালেক
জাহিদ মালেক

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক কোম্পানি বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের কাছে ১৩১ কোটি টাকার দেনাদার ছিল ৩১ জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত। কোম্পানিটির অন্যতম শেয়ারহোল্ডার স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এর আগে তিনবার খেলাপি তালিকা থেকে কোম্পানিটি নাম কাটিয়েছে পুনঃ তফসিল করে করে। চতুর্থবার পুনঃ তফসিল করতে গেলে গত অক্টোবরে অগ্রণী ব্যাংক বিডি থাই ফুডকে জানায়, পুঁজিবাজার থেকে তোলা ১৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫ কোটি টাকা অগ্রণী ব্যাংককে দেওয়ার যে শর্ত ছিল, তা আগে পূরণ করা হোক। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রার্থী হওয়া ঝুঁকির মধ্যে পড়লে তাঁর পক্ষে বিডি থাই ফুড জমা দেয় ১ কোটি টাকা। আর দেয় বাকি ৪ কোটি টাকার চারটি চেক, যেগুলো পাস হবে ২০২৪ সালজুড়ে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মানিকগঞ্জ–৩ আসন থেকে নির্বাচন করছেন।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি ঋণই পেয়েছে ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে। ব্যাংক যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। আর সম্প্রতি পুনঃ তফসিলের সুবিধা নিতেও আশ্রয় নিয়েছে তদবিরের। তদবিরের কথা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে ও বিডি থাই ফুডের পরিচালক রাহাত মালেকও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিডি থাই ফুডকে কোনো আনুকূল্য দেখায়নি। দেখালে আর পরিদর্শন প্রতিবেদনে যোগসাজশে ঋণের কথা বলা হতো না। কোনো ব্যত্যয় হয়ে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকই যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’

বিডি থাই ফুড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০২২ সালে। পুঁজিবাজার থেকে ১৫ কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য ২০১৯ সালের ২২ জুলাই আবেদন করলে অগ্রণী ব্যাংক ৫ কোটি টাকা জমা দেওয়ার শর্তে তা অনুমোদন করে। কোম্পানিটি ওই শর্ত পূরণ করেনি। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটি বরং শর্ত শিথিলের আবেদন জানায় অগ্রণী ব্যাংকে। এমন দাবিও করা হয়, তারা এখন সুদ তো দিতে পারবেই না, ঋণের কিস্তিও দিতে পারবে না। এ আবেদন অবশ্য অগ্রণী ব্যাংকের পর্ষদে দুই দফা নাকচ হয়ে যায়।

অগ্রণী ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়, নাকচ হওয়ার পরই প্রস্তাব পাসে তদবিরে নামেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। তবে ওই কর্মকর্তার তদবিরে নতুন করে প্রস্তাব উত্থাপন করেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মুর্শেদুল কবির এবং গত অক্টোবরে তা পাস হয়। অগ্রণী ব্যাংকের ভাষ্য, তাদের মোট খেলাপি ঋণ এখন কমবে। ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে চতুর্থবারের মতো ঋণ পুনঃ তফসিল করতে পেরেছে কোম্পানিটি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিডি থাই ফুডকে কোনো আনুকূল্য দেখায়নি। দেখালে আর পরিদর্শন প্রতিবেদনে যোগসাজশে ঋণের কথা বলা হতো না। কোনো ব্যত্যয় হয়ে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকই যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক

বিডি থাই ফুডের চেয়ারম্যান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বোন রুবিনা হামিদ। অন্য পরিচালকেরা হলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেক, রুবিনা হামিদের স্বামী কাজী আকতার হামিদ এবং এই দম্পতির ছেলে রায়ান হামিদ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর মেয়ে সিনথিয়া মালেক পরিচালনা পর্ষদে না থাকলেও অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। তাঁদের মালিকানাধীন বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম ও সানলাইফ ইনস্যুরেন্সও ২৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক।

বিডি থাই ফুডের কারখানা ঢাকার ধামরাইয়ের বড় নারায়ণপুর এলাকায়। কোম্পানিটির দাবি অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এ কারখানায় বিভিন্ন পানীয় পণ্য যেমন মিনারেল ওয়াটার, লেমন, অরেঞ্জ, ম্যাঙ্গো ড্রিংকসসহ চকলেট, ঝালমুড়ি, মটরভাজা, চানাচুর এবং টোস্ট বিস্কুট উৎপাদন শুরু হয়।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মো. মুর্শেদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ আদায়ের চেষ্টা চলছে। আর কোম্পানিটি ভবিষ্যতে ভালো করবে বলে আশা করা যায়।’ আরও কিছু জানতে হলে তিনি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ কে এম ফজলুল হকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এ কে এম ফজলুল হক বলেন, ‘বিডি থাই ফুডকে আমরা কোনো ছাড় দিইনি। কোম্পানিটির অন্যতম মালিক সানলাইফ ইনস্যুরেন্স বিক্রি হয়ে গেছে। এরও আমরা হিসাব চাইব।’ এর বাইরে কিছু বলতে চাননি তিনি। 

বিডি থাই ফুডের ঋণচিত্র

বিডি থাই ফুডের জন্য প্রথম ঋণ মঞ্জুর হয় ২০১১ সালের ২৪ আগস্ট। এর পর থেকে এ পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের কাছে সুদ-আসলে ১৩০ কোটি ৫২ লাখ টাকার দেনাদার কোম্পানিটি। ব্যাংকের ভাষায় এ টাকা হচ্ছে ‘ বিডি থাই ফুডের একীভূত দায়’। এর মধ্যে রয়েছে ৫৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকার প্রকল্প বা মেয়াদি ঋণ, ৭২ কোটি ৫ লাখ টাকা ক্যাশ ক্রেডিট হাইপোথিকেশন (সিসি হাইপো) এবং ৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা ডিমান্ড লোন।

একীভূত দায়ের মধ্যে ৯৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা হচ্ছে আসল। আর ৩৬ কোটি ১ লাখ টাকা হচ্ছে সুদ। ব্যাংক বলছে, খেলাপি হয়ে যাওয়ার কারণে ২০২৩ সালে আর সুদ আরোপ করা হয়নি। টাকা আদায়ে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়নি।

তিন শ্রেণির ঋণের মধ্যে ২০২২ সালের ৩০ জুন খেলাপি হয়েছে প্রকল্প মেয়াদি ঋণ ও ডিমান্ড লোন। আর সিসি হাইপো খেলাপি হয়েছে একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর। ২০২১ সালের ২৩ আগস্টসহ মেয়াদি ঋণ এর আগে চতুর্থবার বার ও ডিমান্ড লোন একবার পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। তবে সিসি হাইপো ঋণ আগে পুনঃ তফসিল হয়নি, এবারই প্রথম পুনঃ তফসিল হয়েছে। 

বিডি থাই ফুডের উদ্যোক্তা ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যে ঋণের তথ্য (সিআইবি) সংগ্রহ করেছে অগ্রণী ব্যাংক; সে অনুযায়ী স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তাঁর বোন, ছেলে-মেয়েসহ ২০ ব্যক্তি ও ৭ প্রতিষ্ঠান মিলে ব্যাংকের কাছে মোট দায়দেনা রয়েছে ৪৮১ কোটি টাকা। 

বিডি থাই ফুডের চেয়ারম্যান রুবিনা হামিদ গত বুধবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুর দিকে পারলেও শেষে আমরা ভালো ব্যবসা করতে পারিনি। তবে এখন কোম্পানি চালু আছে। বিভিন্ন দেশে রপ্তানির আদেশও পাচ্ছি।’ ভবিষ্যতে ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করা সম্ভব হবে বলে তাঁর দাবি। তবে অগ্রণী ব্যাংকে আবেদন করে তিনি জানান, ব্যাংকটি যে শর্ত দিয়েছিল, ভুলবশত তাঁরা তা প্রত্যাহারে আবেদন করতে পারেননি। এ ভুলের জন্য তাঁরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। 

ঋণ আদায়ের চেষ্টা চলছে। আর কোম্পানিটি ভবিষ্যতে ভালো করবে বলে আশা করা যায়।
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মো. মুর্শেদুল কবির

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, যোগসাজশে ঋণ

বিডি থাই ফুডের ওপর দুটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, গ্রাহক ও ব্যাংকের যোগসাজশে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (তখন ছিলেন মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম) ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে পরিচালনা পর্ষদের মঞ্জুরির শর্ত লঙ্ঘন করে সহায়ক জামানত নিয়েছেন। কোম্পানিটির যেসব যন্ত্রপাতি আমদানি করার কথা, সেগুলোর স্পেসিফিকেশন ও দরপত্র পরিবর্তন করেছেন এমডি। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি জাহাজে ওঠার পর পরিদর্শনবিষয়ক প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রেও পর্ষদ যেসব শর্ত দিয়েছিল, সেগুলো তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। এ ছাড়া সন্তোষজনক লেনদেন না থাকলেও গ্রাহকের সিসি ঋণসীমা বারবার বাড়িয়ে নবায়ন করা হয়। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও অযৌক্তিকভাবে নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। 

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস উল ইসলামকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের কথা পড়ে শোনানো হলে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগের ঘটনা। যত দূর মনে পড়ছে, তাঁদের অসদুদ্দেশ্য নেই এবং নিয়ম মেনেই তিনি কোম্পানিটির অনুকূলে ঋণ মঞ্জুর করেন।

 ২০২২ সালের ১০ অক্টোবরভিত্তিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক আবার বলেছে, জামানত হিসেবে বন্ধকি দলিল ও আমমোক্তারনামা দলিলের কথা উল্লেখ থাকলেও এগুলোর মূল কপি সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে তোলাই হয়নি। বিডি থাই ফুড থেকে কাগজপত্রের চেক লিস্টও পায়নি ব্যাংক। এমনকি গ্রাহকের স্বাক্ষর ব্যাংক পরীক্ষা করেনি। কিস্তি খেলাপির কারণেও ঋণটি নিম্নমানের। এ ছাড়া কোম্পানিটির বন্ধকি সম্পত্তির লোকেশন ম্যাপ ও স্থিরচিত্র ব্যাংকের কাছে নেই। ৩০ কোটি টাকার মূল চেক নেই ব্যাংকের কাছে, আছে ফটোকপি। 

ব্যাংক আমাদের যেভাবে আটকিয়েছিল, এটা ঠিক যে ১ কোটি টাকা নগদ ও ৪ কোটি টাকার চেক না দিয়ে কিছুতেই পুনঃ তফসিল করা যাচ্ছিল না। আমরা তদবির করেছি। টাকা না দিলে এবারের নির্বাচনই করতে পারতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে ও বিডি থাই ফুডের পরিচালক রাহাত মালেক

৩২ কোটি টাকা সুদ ‘ব্লক’

বিডি থাই ফুডের চেয়ারম্যান রুবিনা হামিদ বিদায়ী বছরের শেষ দিকে দুই দফা কোম্পানিটির ঋণ হিসাবের আরোপিত ও অনারোপিত সুদ ১০০ শতাংশ মওকুফ ও ব্লক হিসাবে স্থানান্তরের দাবি করে ব্যাংকে আবেদন করেন। আরোপিত ও অনারোপিত সুদের পরিমাণ ৩২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১২ সালের এ–বিষয়ক নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ওই টাকা ব্লক হিসাবে রেখে দিয়ে পুনঃ তফসিল করেছে অগ্রণী ব্যাংক।

দাবি মেনে অগ্রণী ব্যাংকের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, কোম্পানিটিকে তিন মাস পরপর ব্যাংককে ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সে হিসাবে বছরে পরিশোধ করতে হবে ২৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। কোম্পানিটির সেই বাস্তবতা নেই বলে ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর ছেলে ও বিডি থাই ফুডের পরিচালক রাহাত মালেক গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক আমাদের যেভাবে আটকিয়েছিল, এটা ঠিক যে ১ কোটি টাকা নগদ ও ৪ কোটি টাকার চেক না দিয়ে কিছুতেই পুনঃ তফসিল করা যাচ্ছিল না। আমরা তদবির করেছি। টাকা না দিলে এবারের নির্বাচনই করতে পারতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী।’

ব্যবসা কেমন চলছে, ত্রৈমাসিক কিস্তি কি দিয়ে যেতে পারবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রাহাত মালেক বলেন, ‘ব্যবসা করা মুশকিল। কিস্তির পরিমাণও কম নয়। দেখা যাক, পরে কী হয়।’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের এ ঘটনা শুনে হতাশ লাগছে। চাপ এবং যোগসাজশেই অনেক ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আসলে পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভালো না হলে ব্যাংক খাতে সুশাসন বজায় রাখা কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংককে এত নরম থাকলে চলবে না।