কর্তৃপক্ষের ভিড়ে আরও একটি কর্তৃপক্ষ হচ্ছে

আইনের খসড়ায় যা আছে
• কর্তৃপক্ষ দরপত্র প্রক্রিয়া চলাকালে যেকোনো নথি তলব করতে পারবে
• অনিয়ম পেলে শাস্তি দিতে পারবে না এ কর্তৃপক্ষ। ক্ষমতা শুধু পরামর্শ ও সুপারিশে সীমাবদ্ধ
বক্তব্য

ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

দেশে আরও একটি কর্তৃপক্ষ গঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারি সেবা নিশ্চিত করতে গত এক যুগে অন্তত ৯টি কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে সরকার। এই তালিকায় আরও একটি কর্তৃপক্ষ যুক্ত হচ্ছে।

সরকারি টাকা খরচে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে এবার বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি আইন বা বাংলাদেশ সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষ গঠনের আইন পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া প্রভাবশালী ঠিকাদারদের অনৈতিক দৌরাত্ম্য ঠেকাতেও এই কর্তৃপক্ষ গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।

সিপিটিইউ হলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ছোট একটি ইউনিট। যেকোনো কাজের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এই অনুমোদন মাঝেমধ্যে এত দীর্ঘ হয়ে যায়, ততক্ষণে দরপত্রের মাধ্যমে কেনাকাটার মেয়াদ সীমাই শেষ হয়ে যায়।
ফারুক হোসেন, সাবেক মহাপরিচালক, সিপিটিইউ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সরকারি কেনাকাটাসংক্রান্ত এ কর্তৃপক্ষ গঠন করবে। মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার পর এখন এ–সংক্রান্ত আইনটি পর্যালোচনার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আগামী বাজেট অধিবেশনে আইনটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

কেন এ কর্তৃপক্ষ

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে পাওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের একটি শর্ত হচ্ছে, সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। তারই অংশ হিসেবে এই ধরনের কর্তৃপক্ষ গঠনে দ্রুত আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিটের (ডিপিসি) সর্বশেষ কিস্তির ২৫ কোটি ডলার প্রাপ্তির শর্ত পূরণেও সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষ গঠনের আইন পাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষ গঠনের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) তৎকালীন মহাপরিচালক ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে আইনটির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের মধ্যে কর্তৃপক্ষ চালুর কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিপিটিইউয়ের সব ক্ষমতা, কার্যক্রম, দায়িত্ব ও সম্পদ ওই কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে আইনের খসড়ায়।

জানতে চাইলে সিপিটিইউয়ের সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সিপিটিইউ হলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ছোট একটি ইউনিট। যেকোনো কাজের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এই অনুমোদন মাঝেমধ্যে এত দীর্ঘ হয়ে যায়, ততক্ষণে দরপত্রের মাধ্যমে কেনাকাটার মেয়াদ সীমাই শেষ হয়ে যায়। সরকারি কেনাকাটা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান দরকার। এ জন্য কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা শুধু সুপারিশ, পরামর্শে

বর্তমানে ৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রতিবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করে থাকে। এসব অর্থ এ দেশের মানুষের করের টাকা। বিভিন্ন প্রকল্পে বা রাজস্ব খাতের খরচে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হয়। ঠিকাদার প্রকল্প বাস্তবায়নকারীর চাহিদামতো কাজটি করে দেয়। সরকার ওই ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধ করে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ও ঠিকাদার যোগসাজশে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কেনা হয়। তাই সরকারি কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে ২০০৬ সালে সরকারি কেনাকাটা আইন প্রণয়ন করা হয়। পরে ২০০৮ সালে সরকারি কেনাকাটা বিধিমালা করা হয়। এর ওপর ভিত্তি করে গঠন করা হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)।

এখন আরও বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি গঠন করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের কেনাকাটার বিষয়ে গভীরভাবে নজরদারি করবে। এ জন্য বাড়তি ক্ষমতাও দেওয়া হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। কেনাকাটাসংক্রান্ত যেকোনো দরপত্র, প্রকল্প দলিলাদি ও নথিপত্র তলব করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দরপত্র প্রক্রিয়া চলাকালেও নথি তলবের ক্ষমতা থাকছে কর্তৃপক্ষের।

তবে সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো কোনো অনিয়ম পেলে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকছে না তাদের। তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ পরামর্শ, সুপারিশ ও দিকনির্দেশনার মধ্যে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইন ও নিয়মাবলি পালনে কোনো ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে তা সংশোধনের জন্য ক্রয়কারীকে ক্রয় প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন অথবা সংশোধনের জন্য পরামর্শ ও সুপারিশ অথবা প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবে কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হবেন পরিকল্পনামন্ত্রী। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবেন কর্তৃপক্ষে। এ ছাড়া একজন প্রধান নির্বাহীও নিয়োগ দেওয়া হবে।

এক যুগে ৯টি কর্তৃপক্ষ

গত এক যুগে অন্তত ৯টি কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে সরকার, যেমন ২০১১ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। ২০১০ সালে গঠিত হয় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির আওতায় গত এক যুগে মাত্র একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে আর চলমান রয়েছে ৯টি প্রকল্প।

এ ছাড়া ২০১৬ সালে বিনিয়োগ বোর্ড ভেঙে বাংলাদেশে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডা গঠন করা হয়। এখনো বিডার সেবা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের এক অধিবেশনে বিডার চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে ভারতীয় এক বিনিয়োগকারী এক বছর বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে বিডায় ঘোরাঘুরি করেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন।

এর বাইরে ২০১০ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে তাতে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এখন পর্যন্ত ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হয়েছে, ৩০টির কাজ চলমান।

এ ছাড়া গত এক যুগে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। কোনো কোনোটি সফল হলেও বেশির ভাগ কর্তৃপক্ষের সাফল্য কম বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।