জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর শর্তের বোঝা বাড়াচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (এনবিআর)। বহুজাতিক সংস্থাটির ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। কী হারে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, সেটিও বলে দিয়েছে। তা হলো এনবিআরকে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৬ শতাংশ হারে শুল্ক-কর তথা রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।
গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর শর্ত ছিল—জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছরও লক্ষ্য অর্জন হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। এ রকম অবস্থায়ই আইএমএফের সফররত প্রতিনিধিদল লক্ষ্য বাড়ানোর শর্ত দিয়ে গেছে। গত সপ্তাহে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শর্তের কথা জানায় আইএমএফ।
এদিকে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এনবিআরের কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ রাখার অনুরোধ জানালেও তা মানতে রাজি হয়নি আইএমএফ প্রতিনিধিদল। উল্টো রাজস্ব আদায় বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে তারা। এনবিআরের কর্মকর্তারা তখন আইএমএফকে জানান, জুলাই-আগস্টের অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায় কমেছে। এর জেরে এখনো ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথ হয়ে আছে। কিন্তু আইএমএফ এসব যুক্তি মানতে রাজি হয়নি। তারা রাজস্ব আদায় বাড়ানোর শর্তেই অনড়।
আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় এনবিআরকে নানা ধরনের শর্ত দেয়। বাকি শর্তগুলো পূরণের অগ্রগতি থাকলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারছে না এনবিআর।
গত ৪ ও ৫ ডিসেম্বর এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশে আইএমএফ মিশনের প্রধান জয়েন্দু দে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ রাজস্ব আদায়ের একটি চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য দিয়েছে। এটি আদায় করা অসম্ভব নয়।
এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান নিয়েও অবশ্য প্রশ্ন আছে। এনবিআরের গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হিসাব অনুযায়ী তারা আদায় করেছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাসের হিসাব অনুসারে, এনবিআর আদায় করেছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পার্থক্য ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই পার্থক্যের কারণেও দুই সংস্থার কর-জিডিপির অনুপাতের হিসাবেও ব্যবধান দেখা যায়। যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৩ শতাংশ; অন্যদিকে এনবিআরের হিসাবে তা সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি। আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গত সপ্তাহের বৈঠকে দুই সংস্থার হিসাবের তারতম্য নিয়েও আলোচনা হয়। তখন এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখন থেকে একটি সমন্বিত হিসাব চূড়ান্ত করা হবে।
জানা গেছে, গত কয়েক দশকে দেওয়া কর অব্যাহতি বাতিলের জন্য আবারও চাপ দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির প্রতিনিধিরা এনবিআর কর্মকর্তাদের এসব করছাড় তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। আইএমএফ বলছে, ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে তিন ধাপে বিদ্যমান সব ধরনের করছাড় বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া আয়কর আইনের ৭৬ (১) ধারা বাতিলের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেওয়ার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা বাতিলের শর্তও মানতে বলেছে।
গত পাঁচ দশকে ২০০-এর বেশি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন খাতকে করছাড় দেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে এনবিআর একটি কমিটি গঠন করেছে। এখন করছাড় বাতিলের সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা জানানোর কথা বলেছে ঋণদাতা সংস্থাটি।
আয়কর ও শুল্ক খাতে কত ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে এনবিআর দুটি আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেই প্রতিবেদন অনুসারে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে শুল্কছাড় দেওয়া হয় প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। ভ্যাটছাড়ের হিসাব এখনো করেনি ভ্যাট বিভাগ।
আইএমএফ দেশে একটি একক হারে ভ্যাট আদায়ের পক্ষে। বর্তমানে শূন্য থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত একাধিক হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ।
আইএমএফ করদাতাদের হয়রানি কমাতে অটোমেশনে জোর দিতে বলেছে এনবিআরকে। এ জন্য এনবিআরকে সহায়তা দিতে চায় আইএমএফ।
গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলন এবং পরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব আদায়ে ৩০ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। এনবিআরের হিসাব অনুসারে, গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।