রূপপুর প্রকল্পের ঋণচুক্তি পর্যালোচনা করতে চায় সরকার।
ঋণের আসল পরিশোধ দুই বছর পেছানোর আলোচনায় অগ্রগতি নেই।
সুদের অর্থ চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে নিতে চায় রাশিয়া। এতে বাংলাদেশ নিমরাজি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ নিয়ে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ঋণের আসল পরিশোধের সময় বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দিলেও তাতে অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে রাশিয়ার আগ্রহ এখন খুবই কম; বরং দেশটি এখন সুদের অর্থ চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে নিতে চায়। এতে অবশ্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে কোনো সবুজসংকেত নেই। ফলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছে সরকার।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার রাশিয়ার ঋণে নেওয়া রূপপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলো নিয়ে সম্পাদিত ঋণচুক্তিগুলো পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে ঋণ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একধরনের টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে—এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ (ইআরডি) সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৬ সালে রাশিয়ার ঋণে নেওয়া ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা।
২০১৬ সালে রাশিয়ার ঋণে নেওয়া ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্পটি শেষ হতে আরও দুই বছর লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে ১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার দিচ্ছে রাশিয়া।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘ঋণ পরিশোধ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। ইতিমধ্যে বড় বিনিয়োগ হয়ে গেছে। তাই আবেগের বশবর্তী না হয়ে যুক্তি দিয়ে দর-কষাকষি করা দরকার। আমাদের পরিস্থিতি সঠিকভাবে রাশিয়াকে বোঝানো গেলে সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে।’
কোভিড সংক্রমণ ও ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি চাপে আছে। এ কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রাশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজেও কিছুটা শ্লথগতি আছে। গত আগস্ট মাসে রাশিয়াকে ঋণের আসল পরিশোধের সময় দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। এতে রাশিয়া প্রাথমিকভাবে রাজিও হয়। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইআরডি আগের ঋণচুক্তি কিছুটা সংশোধনে একটি খসড়া তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মতামতও নিয়েছে। কিন্তু এরপর আর অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে আগস্ট মাসে রাশিয়ার পক্ষ থেকেও একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ হিসাবে রাখা রাশিয়ার ঋণের সুদের অর্থ যেন চীনের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে রাশিয়াকে পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ এখনো সাড়া দেয়নি।
এখন পর্যন্ত সুদের ৬৩ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ হিসাবে (স্কেরো অ্যাকাউন্ট) জমা আছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোয় লেনদেনে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ জন্য তারা চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে সুদের অর্থ চেয়েছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে রাশিয়ার ঋণের ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষে আসল পরিশোধ শুরু করার কথা। বাংলাদেশের অনুরোধ অনুসারে, ২০২৯ সালের ১৫ মার্চ থেকে ঋণের আসল পরিশোধের নতুন সময়সীমা ঠিক হতো। গত এক মাসে এ নিয়ে আলোচনার জন্য কোনো বৈঠকের তারিখ ঠিক হয়নি।
গত ২৫ আগস্ট অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দার মন্টিটস্কি। ইআরডি সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধের কিস্তি শুরু ও কোন মুদ্রায় পরিশোধ হবে—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। রাশিয়া তাদের ঋণের সুদ হিসেবে জমা হওয়া অর্থ দ্রুত নিয়ে যেতে চায়।
রূপপুরের এক কিস্তি ৩৯ কোটি ডলার
বাংলাদেশ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার ঋণ নেয়। ২০১৬ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে এ–সংক্রান্ত চুক্তি হয়। ২০১৭ সালে ঋণের অর্থ আসা শুরু হয়। ইতিমধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবছর দুই কিস্তিতে ১১ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় সে দেশের এক্সিম ব্যাংকে এই অর্থ পাঠানো যাচ্ছে না। তা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ হিসাবে জমা হচ্ছে।
১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের মূল কিস্তি (আসল পরিশোধ) শুরু হওয়ার কথা। প্রতিবছর ছয় মাস পরপর দুই কিস্তিতে মোট ৩৮ কোটি ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে। এর সঙ্গে দিতে হবে ১১ কোটি ডলারের সুদ। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদ ও আসলের পরিমাণ কিছু কমবেশি হতে পারে।
পরমাণু শক্তি কমিশনের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, কোডিড ও ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে প্রকল্পটির কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। তাই ঋণের আসল পরিশোধ দুই বছর পেছানো নিয়ে উভয় দেশ একমত হয়েছে। এ জন্য দুই দেশকে একটি প্রটোকলে সই করতে হবে।
রাশিয়ার ঋণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ৬৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদেশি ঋণ নেওয়ার অগ্রাধিকারে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামিক ডেভেলমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি) এ ধরনের বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। আগের আওয়ামী লীগ সরকার চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী ছিল।