করহার বেশি হওয়ার কারণে দেশে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও বেশি বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে, তাঁদেরই আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে—করের আওতা বাড়াতে দেশে এ রকম একটি পদ্ধতি চালু করা যায়। এটা সম্ভব। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় তাঁকে এমন একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। আমলাদের তিনি নির্দেশও দিয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে যাচাই-বাছাই করতে। কিন্তু কঠিন আমলাতন্ত্রের কারণে মুহিতের আমলে কাজটি আর হয়নি।
রাজধানীর পল্টনে আজ শনিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে অনুষ্ঠিত আবুল মাল আবদুল মুহিত স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তাঁর ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এসব কথা বলেন। এতে আরও স্মৃতিচারণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ। ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা এতে সভাপতিত্ব করেন, আর সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যাঁদের এনআইডি আছে, সবাইকে করের আওতায় আনতে পারলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর সংগ্রহের হার বাড়বে। আমি মুহিত ভাইকে বলেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে যাঁদের সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড আছে, তাঁদের কর দিতে হয়। তবে যাঁদের আয় সাড়ে তিন হাজার ডলারের নিচে, তাঁদের কিছু দিতে হয় না। অথচ আমাদের দেশে করদাতারা কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এখন এটা আমার দাবি। যাঁরই এনআইডি থাকবে, তাঁকেই রিটার্ন দাখিল করতে হবে।’
বর্তমানে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হলে করহার শূন্য। পরের এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, পরের তিন লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ, আর করমুক্ত আয়সীমার পরবর্তী চার লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ, করমুক্ত আয়সীমার পরের পাঁচ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ এবং বাকি টাকার ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর কেটে রাখার বিধান রয়েছে।
এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত জুটির কারণে দেশ ও মানুষের মঙ্গল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মানুষের মঙ্গল চান। প্রধানমন্ত্রীর এ চাওয়া কীভাবে অর্জন করা যায়, সেই মাধ্যম বের করতেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ কারণে আমাদের দেশের চেহারা পাল্টে গেছে।’ একসময় সিলেটে নিজের নানাবাড়িতে যেতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগলেও এখন গাড়িতে মাত্র ৪৫ মিনিটে যাওয়া যায় উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নয়নের এটাকে তিনি অন্যতম সূচক হিসেবে মানেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আবদুল মুহিতকে হাত খুলে ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী হঠাৎ মারা গেলে ২০০১ সালে সিলেটের ওই আসনে প্রার্থী খুঁজছিলেন শেখ হাসিনা। আব্দুল মোমেন বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমাকে ফোন করলেন এবং নির্বাচন করার প্রস্তাব দিলেন। আমি রাজি হইনি। তাঁকে বললাম আমার কাছে ভালো একজন প্রার্থী আছে। নেত্রী তাঁর নাম জানতে চাইলেন। বললাম আমার বড় ভাই। তখন শেখ হাসিনা বললেন, তিনি মেজাজ গরম মানুষ। পরে যদিও মনোনয়ন পেয়ে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে ফেল করেছিলেন তিনি। এ ফেল করাটা এক অর্থে ভালো হয়েছে। তখন দলের জন্য ভেতর থেকে কাজ করার সুযোগ পান তিনি এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতে ভূমিকা রাখেন।’
দেশের নামকাওয়াস্তের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন, বিদেশি মিশনে সব জাতীয় দিবস পালনের জন্য সরকারি বরাদ্দ দেওয়া, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা একলাফে দ্বিগুণ করা ইত্যাদি কাজ আবদুল মুহিত স্বচ্ছন্দে করে গেছেন বলে জানান তাঁর ছোট ভাই আব্দুল মোমেন।
আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের শতভাগ বেতন বৃদ্ধি নিয়ে মুহিত ভাইকে বলেছিলাম, এত বেতন বাড়ালে দেশ তো গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালির মতো হয়ে যাবে। তিনি বললেন, আমরা সবার হাতে টাকা তুলে দেব। বড় বাজেট দেব। পরে দেখলাম তাঁর চিন্তা খুবই উদ্ভাবনমূলক। তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।’
সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, আবুল মাল আবদুল মুহিতকে তিনি চেনেন ২০০৯ সাল থেকে। আবদুল মুহিত ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। জ্ঞানের প্রায় সব শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল এবং তিনি ছিলেন তাঁর দেখা একজন বিরল মননশীল মানুষ।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র থাকার সময় ১৯৭৭-৭৮ সময়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব। ছাত্রদের একটা অনুষ্ঠানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। এককথায় বলতে গেলে তিনি ছিলেন মেধা ও মননে অনন্য, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও প্রাণশক্তিসম্পন্ন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন ব্যক্তি। সত্য বলতে তিনি পিছপা হতেন না।
আন্তর্জাতিক এক অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে মাহবুব আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ আরও ভালো করতে পারত। পারেনি রোহিঙ্গাদের কারণে। তাঁর কথা শুনে মিয়ানমারের প্রতিনিধি থ হয়ে গিয়েছিলেন।
স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন ইআরএফের সাবেক তিন সভাপতি মনোয়ার হোসেন, সাইফুল ইসলাম ও শারমিন রিনভী, সাবেক সহসভাপতি শাহনেওয়াজ ও সাধারণ সম্পাদক আবু কাওসার, সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক রিজভী নেওয়াজ, অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিং বিডির বিশেষ প্রতিনিধি কিসমত খন্দকার, বেসরকারি চ্যানেল একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি সুশান্ত সিনহা, ইংরেজি দৈনিক বিজনেস পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান আরিফ, প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম প্রমুখ। তাঁদের প্রায় সবাই ইআরএফের কার্যালয় স্থাপনে বাজেট থেকে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ায় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন আবদুল মুহিতকে।
১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি মারা যান। আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১০ বার এবং তার আগে এইচ এম এরশাদ সরকারের আমলে দুবার অর্থাৎ মোট ১২ বার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন তিনি।