বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ জ্বালানিস্বল্পতা। এ কারণে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিও অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। অর্থনীতিতে ঝুঁকির অন্যান্য ক্ষেত্র হচ্ছে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া, সম্পদ ও আয়বৈষম্য এবং সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের বার্ষিক বৈঠকের আগে গতকাল বুধবার বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকির সাধারণ ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সুনির্দিষ্ট ঝুঁকিগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গে ঝুঁকির উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
মহামারির পর চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে সবচেয়ে কম—বিশ্বব্যাংক সদ্যই এ কথা বলার পর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন দিল। সেখানে তারা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে।
বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অংশীদার হিসেবে কাজ করেছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। মোট ৭১টি কোম্পানির ওপর জরিপ করে ঝুঁকির এই তালিকা প্রস্তুত করেছে তারা।
যোগাযোগ করা হলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এই জরিপ ব্যবসায়ীদের ওপর করা হয়েছে এবং তাতে দেখা গেছে তাঁদের কাছে জ্বালানিসংকট এখন প্রধানতম ঝুঁকি। শিল্পকারখানায় এখন চাহিদার ৬০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
গ্যাসনির্ভর যেসব শিল্প আছে, যেমন সিরামিক, ইস্পাত, টেক্সটাইল—এসব খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্যাসের স্বল্পতা থাকায় শিল্পকারখানায় রেশনিং করা হচ্ছে। এতে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো গ্যাস পেলেও স্থানীয়, বিশেষ করে এসএমই বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। সরকার গ্যাসের মূল্য অনেকটা বাড়িয়েও সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না, যদিও দাম বাড়ানোর সময় বলা হয়েছিল যে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
সেই সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে।
ব্যবসায়ীদের কাছে দ্বিতীয় ঝুঁকি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। গোলাম মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন যে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আছে। প্রত্যক্ষ প্রভাব হলো, মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি জোরালো হয় এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। পরোক্ষ প্রভাব হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে লেনদেনের ভারসাম্য থাকে না এবং ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র (এলসি) খুলতেও সমস্যা হয়। পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের রপ্তানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়।
এবার ব্যবসায়ীরা অর্থনীতিতে ঝুঁকির কারণ হিসেবে বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেছেন—সম্পদ ও আয় উভয় ধরনের বৈষম্য। গত বছর এই বিষয়টি ঝুঁকির তালিকায় ছিল না। ব্যবসায়ীরা কেন বৈষম্যের কথা বলছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই বিষয় সারা বিশ্বেই এখন আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও এখন তার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন।
সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, উচ্চ আয়বৈষম্য থাকলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তেমন একটা বাড়ে না। সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষের হাতে সম্পদ ও অর্থ জড়ো হলে যে সমস্যা হয়, তা হলো তাঁরা সেই অতিরিক্ত অর্থ বেশি ব্যয় করেন না। অনেকে আবার বিদেশে ব্যয় করেন। মধ্য শ্রেণির ভোক্তারা হলেন সমাজের মূল ভোক্তা। তাঁদের আয় না বাড়লে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের গতি কমে যায়।
দেখা গেছে, সমাজে উচ্চ বৈষম্য থাকলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন তীব্র হয়। অর্থাৎ উচ্চ আয়বৈষম্য একটি পর্যায়ে এসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিকূল হয়ে ওঠে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পিছিয়ে থাকবে। এ ক্ষেত্রে যে অর্থায়ন প্রয়োজন, সেই নিরিখে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশকে মাথাপিছু প্রায় ৪০০ ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে ২৩০ ডলারের মতো বিনিয়োগ হতে পারে বলে মনে করছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।
ঝুঁকির পঞ্চম ক্ষেত্রটি হচ্ছে সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সরকারি ঋণ বেড়ে গেলে প্রথমত বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে যায়। এই বিষয়ে ব্যবসায়ীরা অতীতে বারবার উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। সরকারি ঋণ বাড়লে ব্যাংক ঋণের সুদও বেড়ে যায়।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমে গেলে বা ব্যয় বেড়ে গেলে প্রকল্প থেকে প্রাপ্তি কমে যায়। এতে মুদ্রাস্ফীতি হয় এবং সেখান থেকে মূল্যস্ফীতিও হয়। সরকারি ঋণ বেড়ে গেলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হতে পারে, যা বিনিয়োগকারীদের কাম্য নয়।
প্রতিবেদনে বৈশ্বিক পরিসরে আগামী ২ বছরে ১০টি প্রধান ঝুঁকির ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো—যথাক্রমে ভুল ও অপতথ্য, আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা, সামাজিক বিভেদ, সাইবার নিরাপত্তাহীনতা, দেশে অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত, অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, মূল্যস্ফীতি, অনিচ্ছাকৃত অভিবাসন, প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া ও দূষণ।
এর আগে ২০২৩ সালে ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের প্রধান যে পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছিলেন, সেগুলো ছিল—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণসংকট, উচ্চ পণ্যমূল্যের ধাক্কা, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি ও সম্পদের জন্য ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।