প্রবাসী আয়
প্রবাসী আয়

প্রবাসী আয়ে বদলে যাওয়া জনপদ ‘বাঁকড়া’

এই সংবাদ ২০২৪ সালের ২২ জুলাই প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু তখন দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এই সংবাদ সময়মতো অনলাইনে প্রকাশ করা যায়নি। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর এখন তা করা হলো।

যশোর শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মনিরামপুর ও ঝিকরগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী কপোতাক্ষ নদের তীরে গড়ে ওঠা একটি জনপদ ‘বাঁকড়া’। গ্রামীণ এই জনপদের চিত্র ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছেন এলাকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাঁকড়া বাজার এলাকায় বর্তমানে তৈরি হয়েছে সুরম্য বহুতল বেশ কিছু ভবন। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ছোট্ট এই বাজারে গড়ে উঠেছে হাজারখানেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সবই হয়েছে প্রবাসী আয়ে। অথচ গ্রামীণ এই জনপদ ৩০ বছর আগেও ‘মাথা মুটে চোরাচালানি’ এলাকা নামে খ্যাত ছিল।

সম্প্রতি সরেজমিনে বাঁকড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাজারসংলগ্ন এলাকায় বাহারি নকশার চারতলার ওপরে অন্তত ৩০টি ভবন রয়েছে। এলাকার মানুষের কাছে এসব ভবন অস্ট্রেলিয়া-ইতালি-মালয়েশিয়া-আমেরিকা ভবন নামে অধিক পরিচিত। এসব ভবনমালিক যে দেশে প্রবাসী, সে দেশের নামেই ভবনগুলো পরিচিতি পেয়েছে। অর্থাৎ যে দেশ থেকে পাঠানো প্রবাসী আয়ে ভবনগুলো তৈরি, সে দেশের নামেই এলাকার মানুষ ভবনগুলোর নামকরণ করেছেন।

বাঁকড়া বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুর সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, বাজার ও আশপাশের এলাকায় অন্তত ৩০টি বহুতল ভবন আছে। এসব ভবন প্রবাসীদের অর্থে তৈরি। এর মধ্যে অন্তত ৭টি আমেরিকা ভবন, ৬টি ইতালি ভবন ও ১০টি মালয়েশিয়া ভবন হিসেবে পরিচিত। শুধু ভবন নয়, বাঁকড়া বাজারে যতগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম রয়েছে, কোনো কোনো জেলা বা উপজেলা সদরেও ততগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নেই। এই বাজারে জনতা ব্যাংকের একটি পূর্ণাঙ্গ শাখা, আইএফআইসি ব্যাংকের একটি উপশাখাসহ সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৩টি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম রয়েছে।

জনতা ব্যাংক বাঁকড়া বাজার শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই শাখার মাধ্যমে ৪৮২ জন প্রবাসী ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছেন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রবাসী আয় এসেছিল ৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর ২০২২ সালে এসেছিল ১৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতিবছর সর্বনিম্ন ২২ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৩৮ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে এই শাখার মাধ্যমে।

জনতা ব্যাংকের বাঁকড়া বাজার শাখার ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যশোর ও নড়াইল অঞ্চলের মধ্যে বাঁকড়া বাজার শাখা সবচেয়ে বড়। উপজেলা পর্যায়ের অন্য যেকোনো শাখার চেয়ে এই শাখায় লেনদেন বেশি।’

আশরাফুজ্জামান আরও বলেন, বাঁকড়া এলাকা থেকে বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়লেও বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ আসা সেভাবে বাড়েনি; বরং গত কয়েক বছরে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা কমেছে। তবে জনতা ব্যাংকের বাঁকড়া শাখার লেনদেন ভালো। এই শাখার আমানতের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ব্যাংক হিসাব রয়েছে ৩৩ হাজার ৭৯২টি।

বাঁকড়া বাজার এলাকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি বা অবৈধ পন্থায় বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে।

বাঁকড়া এলাকা ঘুরে ও সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকার প্রায় প্রতি বাড়ি থেকেই দু-একজন দেশের বাইরে থাকেন। এলাকায় তরুণ ছেলে তেমন নেই বললেই চলে। মাধ্যমিক পাস করার আগে-পরে তরুণদের বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। বিদেশে গিয়ে তাঁরা অর্থ পাঠাতে শুরু করেন। আর সেই অর্থে পরিবারের স্বজনদের জীবনযাপনে সচ্ছলতা ফেরে। তাতে বদলে গেছে এই এলাকার চিত্র।

এ বিষয়ে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিস উর রহমান বলেন, ‘এই ইউনিয়নে অন্তত পাঁচ হাজার পরিবারের বসবাস। ভোটার রয়েছে ১৯ হাজারের বেশি। পুরুষ ভোটারের সংখ্যা কম। কারণ, ৮৫ ভাগ পরিবারের দু-একজন পুরুষ বিদেশে থাকেন। সে হিসাবে এই ইউনিয়নে অন্তত সাড়ে চার হাজার প্রবাসী রয়েছে। তাঁদের অর্থেই এই জনপদের চেহারা বদলে গেছে। প্রবাসী আয়ে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন ভবন।

প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি পাবদা মাছের চাষ ও ভারতে এই মাছ রপ্তানির কারণে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাও বেশ সচল। ঝিকরগাছা উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাঁকড়া ইউনিয়নে ৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জলাশয়ে মাছ চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ৫০০ হেক্টরে পাবদা মাছের চাষ করছেন ৭০ জন মৎস্যচাষি। ঝিকরগাছা উপজেলায় প্রতিবছর ৩৫ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের মাছ উৎপাদিত হয়।

বাঁকড়া বাজারের বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সবচেয়ে ছোট মাছ চাষি। তাই বছরে দুই কোটি টাকার মাছ বিক্রি করি। পাবদা মাছ চাষ ও তা ভারতে রপ্তানি করে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা ফিরেছে।’

এদিকে প্রবাসী আয়ে এলাকার চিত্র বদলে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে এখানকার জমির দামও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে বাঁকড়া বাজারে এক শতক জমির দাম ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। তা-ও জমি পাওয়া যায় না।

বাঁকড়া বাজারের বাসিন্দা শাহজাহান কবির বলেন, ‘বাজারে আমার মাছের খাবারের দোকান আছে। মাছ চাষে ভালো সাফল্য আসায় এই বাজারে মাছের খাবারের অন্তত ১৫টি বড় দোকান গড়ে উঠেছে। আমি নিজে মাছের খাবারের ব্যবসার পাশাপাশি পাবদা মাছ ভারতে রপ্তানি করি। কমিশনে চাষিদের কাছ থেকে মাছ কিনে পরে তা রপ্তানিকারকদের কাছে সরবরাহ করে থাকি।’

শুরুর কথা

৩০ বছর আগে এই এলাকার মানুষের একটি বড় অংশ চোরাচালানির সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শাড়ি-কাপড়, সয়াবিন তেল, লবণ ও চিনির বস্তা মাথায় নিয়ে এলাকার পুরুষেরা লাইন ধরে সাতক্ষীরা উপজেলার কলারোয়া সীমান্তের দিকে যেতেন। লাইনের সামনে একজন করে ‘লাইনম্যান’ থাকতেন। লাইনম্যানদের কাজ হলো, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর খোঁজখবর দেওয়া। ‘মাথা মুটে চোরাচালানি’ হতো তখন। সে সময় এ এলাকার ঘরে ঘরে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। নব্বইয়ের দশকে সরকার সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে কড়াকড়ি শুরু করলে এলাকার দু-তিনজন জাপানে চলে যান। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে তাঁরা আবার যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তাঁদের আর্থিক সমৃদ্ধি দেখে আরও কয়েকজন উদ্বুদ্ধ হয়ে দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে জাপানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দালালেরা তাঁদের থাইল্যান্ডে নিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যায়। তিন বছর পর তাঁরা বাড়িতে ফিরে আসেন। তখন তাঁরাই মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরু করেন। এভাবে শুরু বাঁকড়ার মানুষের প্রবাসজীবন।

বাঁকড়া বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও প্রবীণ ব্যক্তি মো. আবদুর সাত্তার বলেন, ‘মাথা মুটে চোরাচালানি’ থেকে গত ৩০ বছরে প্রবাসীদের অর্থে বাঁকড়ার অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করে। ১৫ বছরের মধ্যে এলাকায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বড় বড় দালান তৈরি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটেছে।

এদিকে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরলেও এলাকার মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের ভালো কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে বাঁকড়া এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সংসদ সদস্য থাকার সময়ে আমি বাঁকড়াবাসীর জন্য ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও প্রশাসনিক থানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। তবে বাঁকড়া বাজারের মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা ও পয়োনিষ্কাশন নালাসহ ব্লকের ইটের রাস্তা নির্মাণ করেছিলাম। তা এখনো সচল রয়েছে।’

বাঁকড়া এলাকার মানুষের হাতে যে পরিমাণ অর্থ রয়েছে, সে হিসাবে ওই এলাকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিনোদন খাত সেভাবে এগোয়নি। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠতে পারত বলে তিনি জানান।

৩০ বছর আগেও এই এলাকা চোরাচালানের জন্য বেশ পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে সেই চিত্র বদলে গেছে। এখন গ্রামীণ এই জনপদে একের পর এক গড়ে উঠছে অট্টালিকা, সবই প্রবাসী আয়ে। বাঁকড়া বাজার ঘিরেও নানা রকম ব্যবসা গড়ে উঠেছে।