মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা নেই

বিআইডিএসের দুই দিনব্যাপী আলোচনায় অর্থনীতিবিদেরা বললেন, এক বছর ধরেই দেশ বিভিন্ন ধরনের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ব্যয়, বিদ্যুৎ-গ্যাসের খরচ—সব মিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমা শুরু হলেও বাংলাদেশে তা ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ নীতিনির্ধারকেরা এখনো কার দোষে মূল্যস্ফীতি বাড়ল, সেই বিতর্কের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, এই মূল্যস্ফীতি আমদানি করা, এ জন্য দায়ী কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত দুই দিনব্যাপী গবেষণা সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনেও এমনটাই দেখা গেল।

অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য বললেন, মূল্যবৃদ্ধি পুরোটা আমদানি করা নয় এবং এর পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ কারণও রয়েছে। তবে কারণ যা–ই হোক, এই মূল্যস্ফীতি কমানো নিয়ে আসলে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে আলোচনাও কম। কেবল পত্রিকার পাতাতেই জনগণের দুর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে। তবে কেবল মূল্যস্ফীতিই নয়, এক বছর ধরে দেশ বিভিন্ন ধরনের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর প্রশ্নই করলেন, ‘এক বছর তো হয়ে গেল, আর কত দিন এভাবে চলতে থাকবে?’

আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
যে মূল্যস্ফীতি এসেছে, তা মুদ্রা সরবরাহ থেকে আসেনি। এটা স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হওয়া মূল্যস্ফীতি নয়।
আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

গতকাল বৃহস্পতিবার গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই অধিবেশনে সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বর্তমান গভর্নর এর আগে অর্থসচিব পদে ছিলেন। মূলত তিনিই এখন অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নীতিনির্ধারক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এ সময় রিজার্ভ, সুদহার, ডলার–সংকট, প্রবাসী আয়, আমদানি ও হুন্ডিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ছাড়াও ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান এ সময় বলেছেন, ‘আমাদের ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ গত কয়েক বছর মোটামুটি এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। এটা বাড়ানো দরকার। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না। তাহলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোও কঠিন হবে।’

আহসান এইচ মনসুর অর্থনীতিবিদ
মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়েও আমরা তেমন কিছু দেখছি না। পৃথিবীর সব দেশ কী হাতিয়ার ব্যবহার করেছে, আর আমরা কী করছি?
আহসান এইচ মনসুর অর্থনীতিবিদ

মূল্যস্ফীতি নিয়ে দুই নির্ধারক

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দেশে যে দাম বেড়েছে, তা ব্যয়জনিত বা চাহিদাচালিত কিংবা মুদ্রা সরবরাহের কারণেও হয়নি। এটা আমদানি করা মূল্যস্ফীতি। আমদানি করা মূল্যস্ফীতির ওষুধ কিন্তু ভিন্ন। সেখানে সুদের হার বাড়িয়ে এটাকে খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণত মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ে, সে হারে কমে না। উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়লে তা ধীরে ধীরে কমে আসে। এ জন্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উৎকর্ষ করতে পারলে তা কমে আসবে।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ নিয়ে বলেন, ‘গত বছরে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে পরিষ্কার বলা আছে, যে মূল্যস্ফীতি এসেছে, তা মুদ্রা সরবরাহ থেকে আসেনি। এটা স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হওয়া মূল্যস্ফীতি নয়। এ জন্য চাহিদা কমিয়ে ও সরবরাহ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। অপ্রয়োজনীয় পণ্য ও বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এসএমই খাত ও কৃষি খাতকে উৎসাহ দিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটিয়ে আমরা উৎপাদন বাড়াতে চাই, কর্মসংস্থান বাড়াতে চাই। এর মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে আমরা নিজেদের পণ্যে চলতি পারি।’

এক বছর ধরে সংকট

অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর বলেন, এক বছর ধরে দেশ বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি, সুদের হারসহ বিভিন্ন ধরনের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন পর্যন্ত কমছে। বিনিময় হার নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো আছে। বলা হচ্ছে, এভাবে রিজার্ভ কমতে থাকলে বিনিময় হার হয়তো ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘এক বছর তো হয়ে গেল। আর কত দিন এভাবে চলতে থাকবে। এখন রিজার্ভ নিয়ে আমাদের একটা লাইন টানা উচিত যে এই সীমার নিচে আমরা যাব না। এরপর আইএমএফকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে সরকার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করবে, সেটাই কাম্য।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা বলা হচ্ছে না। শুধু পত্রিকাতেই জনগণের দুর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়েও আমরা তেমন কিছু দেখছি না। পৃথিবীর সব দেশ কী হাতিয়ার ব্যবহার করেছে, আর আমরা কী করছি? বরং আমন ধান গেল, বোরো ধান আসবে, ধানের ফলন ভালো হয়েছে, কিন্তু দাম কমেনি। বিশ্ববাজারে সব খাদ্যপণ্যের দামই প্রায় আগের জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। তাই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বিনিময় হার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বিনিময় হারের জন্য হয়তো ২০-২৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। কিন্তু দেশে তেল ও চিনির দাম তো ১০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কেন এই দাম কমছে না, তা ভাবতে হবে। ভারত যদি ৫ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না।’

সরকার কতটা অনুধাবন করেছিল?

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হয়েছে। ২০২২–এর বাজেট যখন করা হয়, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২০ ডলারের পণ্য ৪০ ডলার হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা বাজেট করেছিলাম আমাদের মতো করে। কিন্তু তখন তো সংকেত আসছিল যে যুদ্ধের প্রভাব পড়বে। সেটা অনুধাবন করিনি। এখন এসে প্রবৃদ্ধি কমিয়েছি, রিজার্ভ কমে ৩০ বিলিয়নে নেমেছে, বিনিময় হার ১০৫–এর ওপরে গিয়েছে। তাহলে নীতিনির্ধারকদের কাছে এ ধরনের অনুষ্ঠানের মূল্যটা কী থাকল।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘সুবিধা নেওয়ার জন্য রিসাইকেল হয়ে অন্য দেশ থেকে প্রবাসী আয়ের টাকা আসছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। এ ছাড়া হুন্ডির দুষ্ট চক্র নিয়েও কাজ করতে হবে। হুন্ডির সঙ্গে প্রণোদনা দিয়ে তো আমরা প্রতিযোগিতায় পারব না। এই জায়গাগুলোতে গভর্ন্যান্সের ইস্যুগুলো দেখতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর প্রবাসী আয় নিয়ে বলেন, ‘যখন করোনা ছিল, তখন প্রবাসী আয় এল ২৪ বিলিয়ন ডলার। সেটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। তখন হুন্ডির চাহিদা ছিল না, যাতায়াত বন্ধ ছিল, সবাই বৈধ পথে আয় পাঠিয়েছিল। সেটা যদি আমরা ভিত্তি হিসেবে ধরি, আর যদি এখন ২২ বিলিয়ন পাই, তাহলে বুঝতে হবে ২ বিলিয়ন ডলার হুন্ডি হচ্ছে। ডলারের দামের ক্ষেত্রে হুন্ডির সঙ্গে ব্যাংক প্রতিযোগিতা করবে না, পারবেও না। আমরা চাই, ভারতের মতো হুন্ডিকে বৈধ পথে নিয়ে আসতে। এটা এক দিনেই হবে না। এখন আয় আনাটা সহজ করতে পারলে ধীরে ধীরে বাড়বে। বিকাশ ও নগদকে অ্যাপসের মধ্যে আয় আনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো শুরু করলে ১-২ বছরের মধ্যে হুন্ডির টাকা বৈধ পথে চলে আসবে। হুন্ডির চাহিদা আছে, এটা কমাতে হবে। হুন্ডির চাহিদা কমাতে পারলে ও আয় আনাটা সহজ করতে পারলে ২ বিলিয়ন ডলার আনাটা কোনো বিষয় নয়।’

ডলার–সংকট কবে কাটবে

ডলারের সংকট নিরসন নিয়ে গভর্নর বলেন, ‘ডলারের দাম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আমরা সব ধরনের হিসাব পদ্ধতি পর্যালোচনা করেছি। আমাদের ধারণা আছে, টাকার মান কত হওয়া উচিত। একসময় বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হার ঠিক করে দিত। যখন রিজার্ভ বাড়ছিল, তখন দাম নিয়ে সমস্যা হয়নি। গত বছর সমস্যা প্রকট হয়। তখন দেখলাম ডলারের দাম আটকে রেখে রিজার্ভ ধরে রাখার কোনো পদ্ধতি নেই। এরপর বাজারের দামের সঙ্গে চলে যাই। এর ফলে ডলারের একাধিক দাম হয়ে গেল। রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও আমদানি, সরকারি কেনাকাটায় আলাদা আলাদা দাম হয়ে গেল।’

আব্দুর রউফ তালুকদার এ নিয়ে বলেন, ‘আইএমএফের যে পদ্ধতি আছে, এটা তার সঙ্গে যায় না। আমরা বলেছি, এটা ক্রান্তিকাল। ডলারের দাম সবক্ষেত্রে ২ শতাংশ পার্থক্যের মধ্যে চলে আসছে। সামনে সবক্ষেত্রে ডলারের এক দাম হবে। আরও তিন-চার মাসের মধ্যে ডলার এক দামের মধ্যে চলে যাবে। যেটা হবে বাজারভিত্তিক দাম।’

কেন চলতি হিসাবে ঘাটতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ নিয়ে বলেন, ‘গত এক দশকে অর্থ হিসাব কখনো ঋণাত্মক হয়নি, এখন হয়েছে। এর কারণ, গত এক দশকে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে সস্তা ঋণ নিয়ে এসেছিলেন। সেটা দেশের ঋণের সুদহারের চেয়ে কম ছিল। গত জুনে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ছিল ৭০ বিলিয়ন বা ৭ হাজার কোটি ডলার, যা দুই বছর আগে ছিল ৮০০ কোটি ডলার। এই কারণেও রিজার্ভ বেড়েছিল। তবে এই ঋণ আর সস্তা নয়। এখন এসব ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অনেকেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পরিশোধ করতে ডলার চাইছেন। গত এপ্রিল পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ৬০০ কোটি ডলার ঋণ বেশি করতে হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ঋণ আছে। আমেরিকায় ট্রেজারি বিলের সুদও অনেক বেশি। এ জন্য চলতি হিসাবে ৩০০ কোটি ডলার ঘাটতি রয়ে গেছে। এটা যদি আগামী দুই মাসে শূন্যে আনা যায়, তাহলে বুঝতে হবে কাজ হচ্ছে। এখন আমাদের লক্ষ্য অর্থ হিসাব সমান সমান নিয়ে আসা। এতেই ডলারের দাম বাড়া কমে যাবে, রিজার্ভ বাড়তে থাকবে।’

সমাপনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এমদাদ উল্লাহ মিয়ান ও আবদুল বাকী, আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, বিআইডিএসের প্রফেসরিয়াল ফেলো কৃষি অর্থনীতিবিদ আবদুস সাত্তার মণ্ডল ও গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন।