• প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
• জনগণের মতামত পর্যালোচনা করে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে হবে।
• আগে নেওয়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিচ্ছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
জনগণের মতামত না নিয়ে আর কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যাবে না। এখন থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি করে তা ওয়েবসাইটে দিয়ে জনগণের মতামত নিতে হবে। এরপর জনগণের মতামত পর্যালোচনা করে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে হবে পরিকল্পনা কমিশনে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এমন আদেশ জারি করে গত বুধবার সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের দিয়েছে। এই আদেশের অর্থ হলো, কোনো প্রকল্প প্রস্তাব সম্পর্কে যদি জনগণ নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন, তাহলে সেটি অনুমোদন করবে না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
এত দিন যেকোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠাত। তখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ওই প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করত। ব্যয় ৫০ কোটি টাকার কম হলে পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেই প্রকল্প পাস করতেন। আর খরচ ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে তা প্রধানমন্ত্রীর (বর্তমানে এ দায়িত্বে আছেন প্রধান উপদেষ্টা) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস করা হতো।
জনগণকে যা জানাতে হবে
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করার পর বেশ কিছু বিষয় জনগণকে জানাতে হবে। প্রথমেই প্রকল্পের প্রাথমিক তথ্য (যেমন খরচ, মেয়াদ, উদ্দেশ্য ইত্যাদি) দিতে হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই (যদি থাকে); গ্রহণের পটভূমি ও যৌক্তিকতা; প্রকল্প এলাকা; আর্থিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্য ফলাফল; পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব; দুর্যোগের ঝুঁকি ও ঝুঁকি প্রশমন পরিকল্পনা—এসব তথ্যও জানাতে হবে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিজেদের ওয়েবসাইট প্রকাশ করে তার ওপর মতামত জানানোর জনগণকে দুই সপ্তাহ সময় দিতে হবে। এ জন্য একটি কমেন্ট বক্স তৈরি করবে মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রকল্প প্রস্তাবে সংযোজন বা বিয়োজন করতে হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি ভালো পদক্ষেপ। শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলেই হবে না। কারণ, অনেকে ওয়েবসাইটে দেওয়া কারিগরি দলিলাদি দেখে বুঝবেন না। তাই সহজভাবে দলিলাদি প্রকাশ করতে হবে।
জনসম্পৃক্ততাহীন প্রকল্পের উদাহরণ দিতে গিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, কিছুদিন আগে অংশীজনদের সঙ্গে চট্টগ্রামে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভা হয়। এতে অংশীজনেরা জানান, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের আগে অংশীজন ও স্থানীয় জনগণ জানতেন না কোথায় টানেল হবে। চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প কোথায় নামবে, তা নিয়েও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কখনো আলাপ করেনি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নামানো হয়েছে। প্রকল্প নেওয়ার আগে জনগণের মতামত নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন।
জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্প নেওয়ার প্রক্রিয়া সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তাগিদ দেন। প্রকল্প পাসের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া কঠোর করার নির্দেশ দেয়।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি ভালো পদক্ষেপ। শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলেই হবে না। কারণ, অনেকে ওয়েবসাইটে দেওয়া কারিগরি দলিলাদি দেখে বুঝবেন না। তাই সহজভাবে দলিলাদি প্রকাশ করতে হবেসেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম।
বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারসহ অতীতে সব আমলেই অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়ার অভিযোগ আছে। প্রকল্পের খরচ বেশি দেখিয়ে অর্থ লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সরকারঘনিষ্ঠ একশ্রেণির লোকজনকে ঠিকাদারি দেওয়ার জন্যও বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প পাস করা হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, প্রকল্প পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তা পাস, ঠিকাদার নিয়োগ, জমি অধিগ্রহণ—পুরো প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনা হচ্ছে। এবার প্রকল্প পাসের পর বাস্তবায়ন কতটা হলো, তা-ও নিয়মিত তদারকিতে রাখা হবে।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ যাবে
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজটি করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সাবেক এমপিদের নিজেদের এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখার প্রকল্পগুলো ইতিমধ্যে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কিছু প্রকল্প পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এই তালিকায় আছে ফরিদপুর-কুয়াকাটা মহাসড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ; মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নে সমন্বিত প্রকল্প; র্যাব সদর দপ্তর নির্মাণ; চিলমারী নদীবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্পে খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া কিছু আবাসিক ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্পও বাদ যেতে পারে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তারা এডিপির সব কটি প্রকল্প মূল্যায়ন করে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করছে। প্রাথমিকভাবে ১০০-র মতো প্রকল্প বাদ বা এগুলোয় অর্থ বরাদ্দ স্থগিত করা হতে পারে।
উন্নয়ন প্রকল্পের নামে টাকা খরচের ‘উৎসবে’ লাগাম টেনে ধরা শুরু করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ১৩টি প্রস্তাব।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এতে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৩৫২টি।