আয় খেয়ে ফেলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কমাতে পারছে মূল্যস্ফীতি; কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এ অবস্থায় নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ।

পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা আর্জেন্টিনার মতো এখনো গভীর সংকটে থাকা কিছু দেশ ছাড়া অন্যরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে। ভারতে মূল্যস্ফীতি এখন ৫ শতাংশের নিচে, যা গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। মূল্যস্ফীতি কমছে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো দেশগুলোতেও। নানা উদ্যোগ নিয়ে মূল্যস্ফীতি কমাচ্ছে অন্যরাও। কিন্তু স্বস্তি নেই বাংলাদেশে। এখানে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সংসার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যদিও সরকারের হিসাবে গত এক বছরে দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, মজুরিও বেড়েছে। টাকার অঙ্কে বেড়েছে মাথাপিছু আয়। কিন্তু সবই কাগজে-কলমে হিসাব। আর তাতে সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি পাচ্ছে না; বরং সংসার চালাতে অনেককে ধারদেনা করতে হচ্ছে। ভাঙতে হচ্ছে সঞ্চয়। মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতিই খেয়ে ফেলছে মানুষের আয়।

পরিকল্পনামন্ত্রী মনে করেন, জিনিসপত্রের দাম ঠিক রাখতে হলে বাজার নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। এবার চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে। গুদাম এবং কৃষকের ঘরে পর্যাপ্ত চালের মজুত আছে। এটি ভবিষ্যতে স্বস্তি দেবে।

এ রকম এক পরিস্থিতিতে আগামী ১ জুন নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে, নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ থাকবে। সরকার এ জন্য ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর কথা ভাবছে। কিন্তু তাতে আয়করে সামান্য ছাড় পাবে ঠিকই, কিন্তু বাজার তাতে আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। আবার আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা খাতে নতুন কর্মসূচি আসছে না। প্রতিবারের মতো পুরোনো কর্মসূচিগুলোতে সুবিধাভোগী কিছুটা বাড়বে, ভাতাও কিছুটা বাড়বে। ফলে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ কতটা স্বস্তি পাবে, এ নিয়েও রয়েছে নানা সংশয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোই হবে নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রীর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।

অসুখ চলছে, প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়ে গেছে। জুলাই মাস পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এখনই ওষুধ খেয়ে ফেলা উচিত।
পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর

সাধারণ মানুষ কষ্টে

আবদুল্লাহ আল মামুন উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় হিসাব বিভাগে চাকরি করেন। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ চারজনের সংসার। বেতন ছিল ৩২ হাজার টাকা। এক বছর আগেও বাসাভাড়া, বাজার খরচ, সন্তানের পড়াশোনার খরচ টেনেটুনে চালিয়ে নিতেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না। গত এক বছরে নিত্যপণ্য, যাতায়াত, সন্তানের পড়াশোনা—সব খরচই বেড়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে বেতন ৫ হাজার বেড়ে ৩৭ হাজার টাকা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু খরচ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি।

আবদুল্লাহ আল মামুন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাতে পারতাম। গত এক বছরে সংসার খরচ ২৫-৩০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু বেতন সেই হারে বাড়েনি। আমাদের মতো মানুষের তো সঞ্চয় থাকে না। তাই ধারদেনা করে জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। গত বছর সন্তানকে স্কুলে না দিয়ে এক বছর বাসায় পড়িয়েছি।’

দেশের নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের বেশির ভাগ পরিবারের অভিজ্ঞতা মোটামুটি এ রকমই।

এক বছর ধরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব ধরনের জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মাছ-মাংসসহ খাবারের দাম বাড়লে আগে কষ্ট বাড়ত, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ত। এবার শুধু খাবার নয়; তেল, সাবান, প্রসাধনসামগ্রী, পোশাক-আশাক, শিক্ষাসামগ্রী, যাতায়াত—সবকিছুর দাম বাড়তি। ফলে নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের মানুষকে সংসার চালাতে প্রতিটি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে কিংবা বাজারের তালিকায় কাঁচি চালাতে হচ্ছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি বেড়েছে, অন্যদিকে মজুরি কম বাড়ছে। তবে ভালো কথা হলো, গত মাসে মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। এই ধারা ধরে রাখতে হবে। আয় বাড়াতে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন বেসরকারি খাতও এটি অনুসরণ করলে মানুষের আয় বাড়বে, মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা প্রশমন হবে। আমার লক্ষ্য হলো, আগামী দু-তিন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনা।’

পরিকল্পনামন্ত্রী মনে করেন, জিনিসপত্রের দাম ঠিক রাখতে হলে বাজার নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। এবার চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে। গুদাম এবং কৃষকের ঘরে পর্যাপ্ত চালের মজুত আছে। এটি ভবিষ্যতে স্বস্তি দেবে।

এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি কম

আয় বেশি হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা নেই। সহজ করে বলা যায়, মূল্যস্ফীতি যদি ৮ শতাংশ হয়, মজুরি বৃদ্ধির হার যদি এর চেয়ে বেশি হয়, তাহলে বাড়তি দাম দিয়েও কিনতে পারেন ক্রেতারা।

কিন্তু দেশে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার এক বছর ধরেই কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের মে মাস থেকে প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এর চেয়ে কম হারে মজুরি বেড়েছে। যেমন গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর পরের ১১ মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশে পৌঁছে। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির হার সোয়া ৭ শতাংশের বেশি উঠতে পারেনি। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশের বিপরীতে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

সাধারণত মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি থাকে। গত এক দশকের মধ্যে এবারই এত দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির মতো। তাঁদের প্রায় সিংহভাগই মজুরিনির্ভর। এই শ্রেণির মানুষের ওপরই মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম আছে। গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্তের ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশা দিয়ে এই মজুরি হার নির্ধারণ করা হয়। এতেই বোঝা যায়, এই শ্রেণির ওপর কতটা চাপ যাচ্ছে। দেখা গেছে, গত এক বছরে বস্ত্র ও নির্মাণ খাতেই মজুরি সবচেয়ে কম হারে বেড়েছে। সব মিলিয়ে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বিবিএসের হিসাবেই কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিন খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। একদিকে আয় কমেছে, কর্মসংস্থান কমেছে। ব্যয়ের চাপ বেড়েছে। সার্বিকভাবে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ও জীবিকার সংকট আরও বেড়েছে।

৯ মাসে মূল্যস্ফীতি সাড়ে আটের নিচে নামেনি

জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। এতে পণ্য বা সেবা কিনতে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, গত এক বছরে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম সাড়ে ৪ থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে। চাল কিনতেই সংসার খরচের ২৫ শতাংশের মতো খরচ হয়। এ ছাড়া আটার দাম ২১ শতাংশ, পেঁয়াজ ৭২-৮৬ শতাংশ, অ্যাংকর ডাল ২ শতাংশ, দেশি মরিচ ৯৫ শতাংশ, হলুদ ১৯ শতাংশ, চিনি ৬২ শতাংশ, লবণ ১৮ শতাংশ, ডিমের দাম ২৩ শতাংশ বেড়েছে। আর মাছ-মাংসের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য যেমন খাতা-কলম, পোশাক, তেল, সাবান—প্রায় সবকিছুর দাম বেড়েছে। যাতায়াত খরচেও বেশি খরচ করতে হচ্ছে।

গত বছরের আগস্ট মাসে হঠাৎ করে অকটেন, পেট্রলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৩৩ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর কয়েক দফা গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়। আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যে বেশি দামে আমদানি করতে হয়েছে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি এক লাফে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ হয়। এরপর কোনো মাসে বেড়েছে, কখনো কমেছে। কিন্তু গত ৯ মাসে সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়।

আমরা কেন পিছিয়ে

মূল্যস্ফীতি কেন কমাতে আমরা পারছি না—এ বিষয়ে জানতে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের মনোভাব হলো, ইউক্রেন যুদ্ধসহ দেশের বাইরের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এ জন্য আমাদের কোনো দোষ নেই। এটা আংশিক সত্য; পুরো সত্য নয়। দেশের ভেতরেও সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। আমরা কি কলকারখানা, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ দিতে পেরেছি? এখন যতই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হোক না কেন, বিদ্যুৎ কোম্পানির রাজস্ব আসছে টাকায়; কিন্তু তাদের নানা ধরনের পরিশোধ বিল করতে হচ্ছে ডলারে। চলমান ডলারের সংকট রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় দিয়ে পূরণ করা যাচ্ছে না।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘ডলার-সংকট আমরা দীর্ঘায়িত করে ফেলেছি। ডলার-সংকট না কাটলে পণ্যের সরবরাহ-সংকট কাটবে না। রিজার্ভ কমতেই থাকবে। গত ১২ মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমেছে। আগামী কয়েক মাসে রিজার্ভ কমলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দেবে, যা সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে। তাই আইএমএফের জন্য আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এখনই মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘অসুখ চলছে, প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়ে গেছে। জুলাই মাস পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এখনই ওষুধ খেয়ে ফেলা উচিত।’ বাজেটের কৃচ্ছ্র সাধনের আরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত।