দেড় দশক আগে নরসিংদীর চৌয়ালা এলাকায় মাত্র আড়াই লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে থান কাপড় তৈরির কারখানা স্থাপন করেন খলিল মিয়া। শুরুতে তাঁর কারখানায় মেশিনের সংখ্যা ছিল ১৬। কর্মী ছিলেন ১৫-১৬ জন। সময়ের ব্যবধানে তার ব্যবসার সঙ্গে কারখানার সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে তাঁর চারটি কারখানায় কাজ করেন ১২৫ কর্মী। কারখানাগুলোতে সপ্তাহে ১ লাখ ৬০ হাজার গজ কাপড় উৎপাদিত হয়।
ব্যবসার একপর্যায়ে পুঁজির সংকটে পড়লে প্রাইম ব্যাংক থেকে সাত লাখ টাকা ঋণ নেন খলিল মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সে সময় ঋণ না পেলে ব্যবসা বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতে হতো। তারপর আবার চলতি মূলধন জোগাতে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। পরিশোধও শেষ।’ ব্যবসা ভালো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
খলিল মিয়ার মতো এভাবেই হাজার হাজার কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (সিএমএসএমই) দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। তাঁদের এই অবদান প্রতিবছরই বাড়ছে। প্রথম দিকে ব্যাংকঋণ সহজলভ্য না হলেও নিজের জমানো টাকা, স্বামী বা স্ত্রী কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারকর্জ নিয়েই ছোট কলকারখানায় বিনিয়োগ করেছেন ছোট ও নবীন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রতিবছরই সিএমএসএমই খাতের অবদান বাড়ছে। অর্থনীতিতে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর সিএমএসএমই খাতের মূল্য সংযোজন ছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছর অর্থনীতিতে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) মূল্য সংযোজন ছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। পরের বছর সেটি ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এমএসএমই খাতের মূল্য সংযোজন ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়ে ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। একইভাবে গত অর্থবছর কুটির শিল্পের মূল্য সংযোজন সাড়ে ১৭ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিসিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মধ্যে বড় শিল্পের ১১ দশমিক ২০ শতাংশ, এমএসএমইর ৭ দশমিক ৩৫ এবং কুটির শিল্পের হিস্যা ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা কত তার সঠিক হিসাব নেই। ২০২০ সালে প্রকাশিত বিবিএসের উৎপাদন শিল্প জরিপ অনুযায়ী, দেশে ভারী শিল্পের সংখ্যা ২ হাজার ৮৫৬টি। আর অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার। তার মধ্যে অতি ক্ষুদ্র ১৬ হাজার ৭৭০টি, ছোট ২৩ হাজার ৩০৬টি ও মাঝারি কারখানা রয়েছে ৩ হাজার ১৭৮টি।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের এসএমই ও কৃষি ঋণ বিভাগের প্রধান আসিফ খান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ, নীতি ও নির্দেশনায় সিএমএসএমই খাত আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। খাতটি বর্তমানে যেকোনো সময়ের তুলনায় মজবুত অবস্থায় রয়েছে। সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা ক্ষতি কাটিয়ে ব্যবসায় ফিরে আসতে পেরেছেন। এই খাতের প্রত্যক্ষ অবদানে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
এসএমইর ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যবসায় বড় চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে এফএম প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ গাজী তৌহীদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে উদ্যোক্তারা বর্তমানে লোডশেডিংয়ের কারণে বেশি ভোগান্তির মধ্যে আছেন। ১ থেকে দেড় ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। রোজার পর থেকে শুধু এ কারণেই আমরা লোকসান গুনছি। এ ছাড়া করের চাপে বিপর্যস্ত।’
উৎপাদন শিল্প জরিপ অনুযায়ী, দেশের অতি ক্ষুদ্র শিল্পকারখানার ৪৮ শতাংশের ব্যাংকঋণ আছে। এর মানে, ৫২ শতাংশ কারখানার মালিক নিজের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। ছোট শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের ঋণ আছে। বাকি ৪৩ শতাংশ নিজের টাকা বিনিয়োগ করেছেন। মাঝারি উদ্যোক্তাদের ৬১ শতাংশের ব্যাংকঋণ আছে।
ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে এখনো সমস্যা আছে বলে মন্তব্য করলেন সিএমএসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মাসুদুর রহমান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর সিএমএসএমই খাতে ব্যাংকঋণ বাড়ছে। কয়েকটি ব্যাংকের সিংহভাগ ঋণ এই খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সচেতন আছে। রাতারাতি পরিবর্তন না হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।